বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আল্লাহর ঘর মসজিদ নিয়েও এখন জাল হাদীস এর আসর!

আল্লাহর ঘর মসজিদ নিয়েও এখন জাল হাদীস এর আসর!
প্রশ্ন : আমাদের সমাজে দেখা যায়, হাদীস বলে নিম্ম কথাটি বলা হয়-
‘‘মসজিদে কেউ প্রথমবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বন্ধু আপনি চুপ করুন। আবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বান্দা তুমি চুপ কর। তৃতীয়বার কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর দুশমন তুই চুপ কর।’’
আমার জানার বিষয় হলো, এটি হাদীস কি না?
উত্তর : এটি হাদীস নয়; হাদীসের কিতাবসমূহে এটি পাওয়া যায় না। মাসিক আল কাউসার, মার্চ-২০১৪ পৃ.-৩০।
এ বিষয়ক আরো দুটি ভিত্তিহীন বর্ণনা উল্লেখযোগ্য-
المصنوع في معرفة الحديث الموضوع (ص: 92)
109 - حَدِيثُ الْحَدِيثُ فِي الْمَسْجِدِ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ الْبَهِيمَةُ الْحَشِيشَ لَمْ يُوجَدْ كَذَا فِي الْمُخْتَصَرِ
০১. মসজিদে (দুনিয়াবী) কথাবার্তা নেকিকে এমনভাবে খতম করে, যেমন চুতষ্পদ প্রাণী তৃণলতাকে শেষ করে দেয়। আল মাসনূ-৯২, হাদীস-১০৯।


মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.-১০১৪) বলেছেন, এভাবে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। এমনি ভাবে মুখতাসার এর মাঝে রয়েছে। আল মাসনূ-৯২, হাদীস-১০৯, আল আসরারুল মারফূয়া-১৮৬, হাদীস-১৭১। আল্লামা ফাত্তানী (রহ.-৯৮৬)  لَمْ يُوجد. এধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় না বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তাযকেরাতুল মাওযুআত-৩৬। আল্লামা সুবকী (রহ.-৭৭১) একটি অনুচ্ছেদে-هَذَا فصل جمعت فِيهِ جَمِيع مَا فِي كتاب الْإِحْيَاء من الْأَحَادِيث الَّتِي لم أجد لَهَا إِسْنَادًا من كتاب الْعلم ইমাম গাজালী (রহ.) এর রচিত কিতাবুল ইলমে যেই সব হাদীস এর সনদ খুজে পাননি, তার আলোচনা করতে গিয়ে উক্ত বর্ণনাটিকেও উল্লেখ করেছেন। তাবাকাতুশ শাফেইয়্যাতিল কুবরা-৬/২৯৪। শাইখ নাসীর উদ্দীন আলবানী (রহ.-১৪২০)ও উক্ত বর্ণনাটি ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছেন-
سلسلة الأحاديث الضعيفة والموضوعة وأثرها السيئ في الأمة (1/ 60)
4 - (الحديث فى المسجد يأكل الحسنات كما تأكل البهائم الحشيش) .
لا أصل له.
أورده الغزالي في " الإحياء " (1 / 136) فقال مخرجه الحافظ العراقي: لم أقف له على أصل وبيض له الحافظ في " تخريج الكشاف " (73 / 95 و130 / 176) .
وقال عبد الوهاب بن تقى الدين السبكي في " طبقات الشافعية " (4 / 145 - 147) : لم أجد له إسنادا.
والمشهور على الألسنة: " الكلام المباح في المسجد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب " وهو هو.
সিলসিলাতুয যয়ীফা....-১/৬০, হাদীস-৪।

الحديث فى المسجد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب
০২.  ‘‘মসজিদে (দুনিয়াবী) কথাবার্তা নেকিকে এমনভাবে খতম করে, যেমন আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে।’’
এটি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হাদীস নয়। আল্লামা সাফফারীনী (রহ.) বলেন, এটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। গিযাউল আলবাব শারহু মানযূমাতিল আদাব-২/২৫৭, আল মাসনূ-৯৩ (টিকা)
হাফেজ ইরাকী (রহ.) বলেছেন যে, তিনি এর কোন ভিত্তি খুঁজে পাননি। আল্লামা যাবীদী (রহ.) হাদীসটির ব্যাপারে হাফেয ইরাকী (রহ.) এর উক্ত অভিমতকে সমর্থন করেছেন। ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন-৩/৩১, আলমাসনূ-৯৩ (টিকা)

আল্লাহর ঘর মসজিদ হলো পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। মসজিদের ভিত্তিই হল নামাযের জন্য এবং যিকির, তালীম ও অন্যান্য দ্বীনী আমলের জন্য। একে দুনিয়াবি কথাবার্তা ও কাজ-কর্মের স্থান বানানো অথবা এ উদ্দেশ্যে মসজিদে জমায়েত হওয়া হারাম। তবে কোন আরামের জন্যে মসজিদে যাওয়ার পর প্রসঙ্গত্রুমে দুনিয়াবী কোন বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েয। তার বৈধতা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। দ্রষ্টব্য সহীহ বুখারী-১/৬৩, ৬৪ ও ৬৫; মুসাফফা-রদ্দুল মুহতার (শামী) ১/৬৬২; আললুউলুউল মারসূ-৭৮। আরো দেখুন মাসিক আল কাউসার-সেপ্টেম্বর-২০০৫ পৃ.-৩৬।
মনে রাখতে হবে, মসজিদ নামায ও আল্লাহ তাআলার যিকিরের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদকে দুনিয়াবী কথাবার্তা ও কাজকর্মের স্থান বানানো অথবা এ উদ্দেশ্যে মসজিদে জমায়েত হওয়া নাজায়েয।
 سنن أبي داود ت الأرنؤوط (2/ 306)
1079 - حدثنا مُسَدَد، حدثنا يحيي، عن ابن عَجلانَ، عن عمرِو بن شعيب، عن أبيه عن جدَّه: أن رسولَ الله - صلَّى الله عليه وسلم - نهى عن الشراء والبَيعِ في المسجد، وأن تُنشَدَ فيه ضَالَّةٌ، وأن يُنشَدَ فيه شِعرٌ، ونهى عن التَّحلُّقِ قبلَ الصَلاةِ يومَ الجمعة
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে বেচা-কেনা বা হারানো বস্তু খুঁজে পাওয়ার এলান করতে নিষেধ করেছেন...। (সুনানে আবু দাউদ-২/৩০৬, হাদীস-১০৭৯)। شعَيب الأرنؤوط উক্ত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (যা প্রমাণযোগ্য)।
আরেক হাদীসে এ বিষয়ে কঠিন ধমকি এসেছে-
 سنن الترمذي ت شاكر (3/ 602)
1321 - حَدَّثَنَا الحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الخَلَّالُ قَالَ: حَدَّثَنَا عَارِمٌ قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ العَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ قَالَ: أَخْبَرَنَا يَزِيدُ بْنُ خُصَيْفَةَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ ثَوْبَانَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " إِذَا رَأَيْتُمْ مَنْ يَبِيعُ أَوْ يَبْتَاعُ فِي المَسْجِدِ، فَقُولُوا: لَا أَرْبَحَ اللَّهُ تِجَارَتَكَ، وَإِذَا رَأَيْتُمْ مَنْ يَنْشُدُ فِيهِ ضَالَّةً، فَقُولُوا: لَا رَدَّ اللَّهُ عَلَيْكَ "
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কাউকে মসজিদে বেচা-কেনা করতে দেখলে বল, তোমার বেচা-কেনা লাভজনক না হোক। তেমনিভাবে কাউকে যদি মসজিদে হারানো বস্তুর এলান করতে দেখ তাহলে বল, আল্লাহ তোমার হারানো বস্তু ফিরিয়ে না দিন (অর্থাৎ এ কাজটি  খুবই নিন্দনীয়)। (জামে তিরমিযী-৩/৬০২, হাদীস-১৩২১;  সহীহ ইবনে খুযাইমা-১/৬২৪, হাদীস-১৩০৫)। হাদীসটি সহীহ


অতএব মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহীহ কোরআন সুন্নাহ অনুসারে আমল করে, জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা পরিহার করার তাওফীক দান করুন। আমীন
ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ
প্রধান মুফতী ও গবেষক
মারকাযুল ইসলাহ, বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন