মঙ্গলবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

‘যে ফেৎনা ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে আকড়ে ধরবে, তার জন্য রয়েছে একশত শহীদের সাওয়াব’’ এ হাদীস এর তাহকীক।


‘যে ফেৎনা ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে, তার জন্য রয়েছে একশত শহীদের সাওয়াব’’ এ হাদীস এর তাহকীক।


✏  গত এক মাসের মাঝে নিন্মে হাদীসটি নিয়ে একধিক ভাই প্রশ্ন করেছেন ‘‘যে ফেৎনা ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে, তার জন্য রয়েছে একশত শহীদের সাওয়াব’’ এ হাদীসটি কতটুকু সহীহ বা কোন কিতাবে উল্লেখ আছে?

আসুন প্রথমে আমরা সনদ বা সূত্রসহ হাদীসটি  দেখি-
01 হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে-


الكامل (3/ 174)
حَدَّثَنَا عَبد اللَّه بْنُ مُحَمد بْنِ مُسْلِمٍ، حَدَّثَنا الْحَسَنُ بْنُ إبراهيم البياضي، حَدَّثَنا الحسن أبو علي المدائني، حَدَّثَنا عَبد الْخَالِقِ بْنِ الْمُنْذِرِ، عنِ ابْنِ أَبِي نُجَيْحٍ عَنْ مُجَاهِدٍ، عنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَفَعَهُ قَالَ مَنْ تَمَسَّكَ بِسُنَّتِي عِنْدَ فَسَادِ أمتي فله أجر مِئَة شَهِيدٍ.
অর্থ : হযরত ইবেন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূল (সা.) বলেছেন ‘‘যে ফেৎনা ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে আকঁড়ে ধরবে, তার জন্য রয়েছে একশত শহীদের সাওয়াব’’।



 02 হযরত আবূ হুরায়রা  (রা.) এর সূত্রে-

المعجم الأوسط (5/ 315)5414 - حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ أَبِي خَيْثَمَةَ قَالَ: ثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحٍ الْعَدَوِيُّ قَالَ: ثَنَا عَبْدُ الْمَجِيدِ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَطَاءٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُتَمَسِّكُ بِسُنَّتِي عِنْدَ فَسَادِ أُمَّتِي لَهُ أَجْرُ شَهِيدٍ»
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন  যে, ‘‘ফেৎনা ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে আকঁড়ে ধারনকারী,  শহীদের সাওয়াব পাবে’’। 


প্রমাণ সূত্র :  আযযুহদুল কাবীর লিল বায়হাকী-1/118 হাদীস-207, আল কামেল-3/174, আত্ তারগীর ওয়াত তারহীব লিল মুনযীরি-1/41 হাদীস নং-65, আমালি লি ইবনে বুশরান-পৃ.-218, হাদীস-501, আল মুত্তাজিরুর রাবে লিদ দিমইয়াতী-325, মিযানুল ইতেদাল লিয যাহাবী-1/519,  তারিখুল ইসলাম লিয যাহাবী-15/118, মেশকাতুল মাসাবীহ-1/62, হাদীস-176, তাখরীজু মেশকাতুল মাসাবীহ লি ইবনে হাজার-1/136, লিসানুল মিযান-2/346, লাওয়ায়েহুল আনওয়ারুস সুন্নিয়া-01/201 ।
আল মুজামুল আওসাত-5/315, হাদীস-5414, হিলয়াতুল আওলীয়া লি আবূ নুয়াইম-8/200, আল ইবানাতুল  কুবরা লি ইবনে বাত্তা-1/342 হাদীস-212, আল ফাতহুল কাবীর লিস ‍সূয়ূতী (রহ.) 3/242, হাদীস-12530, কানযূল উম্মাল-1/184, হাদীস-936, জামউল ফাওয়ায়েদ লির রাদানী-1/32 হাদীস-142, মাজমাওজ জাওয়ায়েদ-1/172, হাদীস-800 ইত্যাদি 


উল্লেখিত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের মন্তব্য

01 :  সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ব্যাখ্যাবিদ  ও জারাহ ও তাদীলের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)  মৃত-852 তিনি মেশকাতুল মাসাবীহ এর তাখরীজ করতে গিয়ে উল্লেখিত হাদীসটিকে -حسن হাসান বলে মন্তব্য করেছেন। তাখরীজু মেশকাতুল মাসাবীহ লি ইবনে হাজার-1/136 এবং উক্ত কিতাবের ভুমিকার মাঝেও হাসান বলেছেন।
02 :  জারাহ ও তাদীলের বিখ্যাত ইমাম ইবনে আদি  (রহ.) মৃত-365, হাদীসটিকে তার কিতাবে উল্লেখ করে বলেন-لا بَأْسَ بِهِ এর মাঝে কোন সমস্যা নেই। আল কামেল-3/174,
03 :  আল্লামা দিমইয়াতী (রহ.) মৃত-705 তার কিতাবে তাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন-إسناده لا بأس به এই হাদীসের সনদে কোন সমস্যা নেই। আল মুত্তাজিরুর রাবে লিদ দিমইয়াতী-325।
04 : আল্লাম মুনযীরি (রহ.) মৃত-656 তিনি তার কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন-وإسناده لا بأس به এই হাদীস এর সনদে কোন সমস্যা নেই। আত্ তারগীর ওয়াত তারহীব লিল মুনযীরি-1/41
05 : আল্লামা মুহাম্মদ  ইবনে  জারুল্লাহ আসসাদী (রহ.) মৃত-1181 বলেন হাদীসটি হাসান । আন নাওয়াফীউল আতরা-420 ।

আহলে হাদীস ভাইদের মহাগুরু আলবানী সাহেবর অনাধিকার চর্চা
তিনি তার লিখিত গ্রন্থ ‘সিলসিলাতু আহাদীসিয যয়ীফা’’ এর 1/498 এর মাঝে উক্ত হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, ইমাম মুনীরি (রহ.) মৃত-656 এর  হাদীসটি সম্পর্কে উক্তি-‘‘‘وإسناده لا بأس به এই হাদীস এর সনদে কোন সমস্যা নেই। ’’’ এই মন্তব্য করার কারণে আলবানী সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন-أن قول المنذري (1 / 41) : وإسناده لا بأس به، ليس كما ينبغي. ‘‘ইমাম মুনযীরি  যে বলেছেন হাদীসটিতে কোন সমস্যা নেই ’’ এ কথা বলা তার কোন ভাবেই উচিত হয় নি!!!
 দেখুন আলবানী সাহেবের থেকে  ইলম ও বয়স সব দিকে বড় এবং হাদীসের অনেক বড় একজন ইমামের বিষয়, আলবানী সাহেব এধরনের মন্তব্য করা কি কোন ভাবেই উচিৎ????? প্রিয় পাঠক আপনিও ভাবুন!!

কিছু আপত্তি
উল্লেখিত দুটি হাদীসের সনদে দুইজন বর্ণনাকারীকে নিয়ে কিছু মুহাদ্দীসগণ আপত্তি করেছেন, তার মধ্য থেকে একজন হলেন-হাসান আবূ আলী  আর দিত্বীয়জন হলেন আব্দুল মাজিদ । আসুন আমরা দুইজন সম্পর্কে কিছু ধারনা নিয়ে নিয়-

                                                আব্দুল মাজিদ সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের মন্তব্য
01 : সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ব্যাখ্যাবিদ , জারাহ ও তাদীলের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)  মৃত-852 তার সম্পর্কে বলেন- صدوق يخطىء সে বিশ্বস্ত কিন্তু কতক সময় ভুল করতেন ।
02 :  ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন-عَبد المجيد بن أَبي رواد ثقة তিনি নির্ভরযোগ্য।
03 : ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাইন বলেন-عَبد المجيد بن أَبي رواد ثقة তিনি নির্ভরযোগ্য।
04 :  ইমাম ইব্রাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাইদ বলেন যে, ইমাম ইয়াইয়াহ,  আব্দুল মাজিদ এর জ্ঞান এবং বুঝ শক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-قال: وكان صدوقا، ما كان يرفع رأسه إلى السماء، وكانوا يعظمونه তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত এবং কখনো আকাশের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকাতেন না (অর্থাৎ নর্ম ছিলেন) এবং মানুষ তাকে বড় আলেমও মনে করতেন। 
05  : ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) কে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে  তিনি বলেন-فقال: ثقة সে নির্ভরযোগ্য। এবং ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) বলেন কিছু লোক তাকে মুরজীয়া বলে এ কথাটি ভিত্তিহীন ।
06 : ইমাম নাসঈ (রহ.) বলেন-وَقَال النَّسَائي: لَيْسَ به بأس. তার মাঝে কোন সমস্যা নেই । অন্যত্র তিনি বলেন-وَقَال في موضع آخر: ثقة. আব্দুল মাজিদ নির্ভরযোগ্য ।
07 : ইমাম আবূ হাতেম বলেন - يكتب حديثه তার হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করার মত ।
08 : ইমাম হাকেম (রহ.) বলেন-هو ممن سكتوا عنه তার সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণ নিরব ভূমিকা পালন করেছেন ।
09 : ইমাম খলীলি বলেন-قال الخليل ثقة তিনি নির্ভরযোগ্য ।
10 : ইমাম ইবনে জুনায়িদ বলেন- وَقَال ابن الجنيد عنه أيضا: ثقة  তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন ।
11 :  ইমাম ইবনে মুহরীজ বলেন-. وَقَال ابن محرز عَنه: كان والله ما علمت رجلا صدوقا مسكينا إن سئل عن شيء حدث، وإلا فهو ساكت আল্লাহর কসম! আমি তাকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে জানি। তাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাব দিতেন, অন্যথায় চুপ থাকতেন । 
12 : আহলে হাদীস ভাইদের মহাগুরু আলবানী সাহেব তার সম্পর্কে বলেন -قلت: وهو مختلف فيه، যে আব্দুল মাজিদ এর বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে । এতটুকু বলেই তিনি ক্ষ্যান্ত হয়ে গিয়েছেন- সিলসিলাতুয যয়ীফা-1/498 ।
  
❁মাত্র এক ডজন ইমামগণের মতামত উল্লেখ করলাম

বি. দ্র. তার সম্পর্কে ইমামগণের আরো অনেক প্রশংসনিয় মন্তব্য রয়েছে, আর তা ছাড়াও তিনি ইমাম বুখারী (রহ.) এর উস্তাদের উস্তাদ (অর্থাৎ ইমাম বুখারী (রহ.) এর উস্তাদ হলেন ইমাম হুমাইদি (রহ.) আর আব্দুল মাজিদ ইমাম হুমাইদি (রহ.) এর উস্তাদ, ) আর ইমাম আহমদ (রহ.) এর ও উস্তাদ। আর সিহাহ সিত্তার সকল ইমাম তার  সূত্রে বর্ণিত হাদীস  নিজ গ্রন্থে সংকলন করেছেন ইমাম বুখারী ব্যতীত ।  তার মৃত্যু-206 হিজরীতে ।

তাকরীবুত তাহজীব-361 জীবনি-4160,  তাহযীবুত তাহযীব-6/381, জীবনি-724, তাহযীবুল কামাল-18/271 জীবনি-3510, তাবকাতে ইবনু সাদ-5/500, তারীখুদ দুয়ারী-2/370, তারীখুদ দারামী-জীবনি-676, রিযালু সহীহিল মুসলিম--পৃ-111, সিয়ারু আলামিন নুবালা-9/434, এছাড়াও আরো অসংখ্য কিতাবে তার জীবনি উল্লেখ রয়েছে ।

                                                     হাসান আবূ আলী সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের মন্তব্য
01 :  জারাহ ও তাদিলের বিখ্যাত ইমাম ইবনে আদী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন-قال ابن عدي: أرجو أنه لا بأس به. তার মাঝে কোন সমস্যা নেই বলেই আমি আস্বস্ত ।  মিযানুল ইতেদাল লিয যাহাবী-1/519 । 

                                                         শেষ সমাধান
  উল্লেখিত হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত দুটি হাদীসই হাসান তথা প্রমাণযোগ্য । আমরা হাদীসটি হাসান হওয়ার বিষয়ে উপরে সরাসরি মুহাদ্দীসদের মন্তব্য পড়েছি। আর তাছাড়াও হাদীস এর মাঝে যে সব বর্ণনাকারীর জীবনি নিয়ে আপত্তি করা হয়, আমরা তা বিস্তারিত ভাবে জেনেছি । তাই তাদের সম্পর্কে মুহাদ্দীস গণের  প্রশংসনিয় মন্তব্য বিরাজ মান, যার কারণে  দুটি হাদীসকে যয়ীফ বলার কোন সুযোগ নেই। ( আর ইবেন আব্বাস (রা.) এর বর্ণনায় হাসান আবূ আলীকে নিয়ে কিছু দূর্বলতা রয়েছে, কিন্তু এর সমর্থনে আবূ হুরায়রা (রা.) এর হাদীসটি থাকায় উক্ত হাদীসও হাসান হাদীসে পরিণত হয়েছে ।)
ভূল ধারণা  
অনেক জায়গায় দেখা যায় এ হাদীসটির অর্থ উঠাতে গিয়ে অনেক ভাই বলেন যে, যে ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর একটি সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরবে সে একশত শহীদের সাওয়াব পাবে, অথচ বিষয়টি এমন নয়। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন- بِسُنَّتِي অর্থাৎ আমার সুন্নাত আর রাসূল (সা.) এর সুন্নাত কি একটি?? না, কখনো না । তাছাড়াও আমরা অন্য একটি হাদীস দেখলে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হতে পারবো আর তা হলো রাসূল (সা.) অন্য একটি হাদীসে বলেন- عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين الخ তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত সমূহ অনুসারে আমল কর ।  এখানেও উল্লেখিত হাদীসটির মত  بسنتى শব্দটি ব্যবহার হয়েছে কিন্তু কাউকে এই স্থানে একটি সুন্নাত এর কথা বলতে শুনা যায় না । তাই আমরা স্পষ্ট যে এখানে একটি সুন্নাত এই অর্থ উঠানো্ সঠিক না ।

  আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাহকীক এর সহিত সঠিক দ্বীন বুঝার তাওফীক দান করুন । আমীন!

  মুফতী মো. ছানা উল্লাহ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন