বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫

৭ম পর্ব : শবে বরাতের বাস্তবতা * সালাফীদের মাথা ব্যথা দলীল দ্বারা প্রমাণিত* কেন তারা মিথ্যায় রত?

৭ম পর্ব : শবে বরাতের বাস্তবতা * সালাফীদের মাথা ব্যথা
দলীল দ্বারা প্রমাণিত* কেন তারা মিথ্যায় রত?
❀ এ পর্বে উল্লেখ করা হবে উক্ত রজনী সম্পর্কে মুহাদ্দীস ও ফুকাহাগণের মন্তব্য (বিশেষ করে আহলে হাদীস/সালাফী ইমামদেরও মতামত) আরো থাকছে এ বিষয়ে রচিত কতিপয় কিতাব।

✏ ০১. শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের অভিমত-
سلسلة الأحاديث الصحيحة وشيء من فقهها وفوائدها (3/ 135)
1144 - وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” (ص ১০৭) عن أهل التعديل والتجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان  حديث صحيح، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه. 
অর্থাৎ সারকথা হচ্ছে, (শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত) হাদীসটি বহু সূত্রের সমষ্টির কারণে নিঃসন্দেহে সহীহ। কোন হাদীস অত্যাধিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ হলে এর চেয়ে কম সূত্রে বর্ণিত হলেও তা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়। আর আলোচ্য হাদীসটি অত্যাধিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত। সুতরাং কাসেমী যে তার কিতাব ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’এ উল্লেখ করেছেন, “শবে বরাতের ফযীলতের হাদীস সহীহ নয়” তার এ কথাটি নির্ভরযোগ্য নয়। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহ-৩/১৩৫, হাদীস-১১৪৪)



❖ বর্তমান যুগের লা-মাযহাবীদের সবচে বড় ইমাম ও মুহাদ্দিস হচ্ছেন, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী। আহলে হাদীসের মহামান্য সে ইমামের মন্তব্য শুনুন। আর শবে বরাত নিয়ে ফিৎনাকারী আহলে হাদীস বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন এ মন্তব্যটি শুনে মানুষের মাঝে ইবাদত নিয়ে বিভ্রান্তির অপপ্রয়াস না চালান।

✏ ০২. আব্দুর রহমান মুবারকপুরী এর অভিমত-
تحفة الأحوذي (3/ 367)
اعْلَمْ أَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ عِدَّةُ أَحَادِيثَ مَجْمُوعُهَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ لَهَا أَصْلًا فَمِنْهَا حَدِيثُ الْبَابِ وَهُوَ مُنْقَطِعٌ وَمِنْهَا حَدِيثُ عَائِشَةَ،ومنها حديث معاذ،ومنها حديث عبد الله بن عمرو، ومنها حديث علي (رض). فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ بِمَجْمُوعِهَا حُجَّةٌ عَلَى مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ لَمْ يَثْبُتْ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ شَيْءٌ. وَاَللَّهُ تَعَالَى أَعْلَمُ 
অর্থাৎ জেনে রাখো যে, শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার সমষ্টি প্রমাণ করে যে, শরীয়তে শবে বরাতের ভিত্তি রয়েছে। এসব হাদীসের মধ্যে আলোচ্য হাদীসটি ছাড়াও রয়েছে হযরত আয়েশা (রা.) হযরত মু‘আয (রা.) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ। এসব হাদীসের সমষ্টি ওদের বিরুদ্ধে অকাট্য দলীল হয়, যাদের ধারণা হচ্ছে শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত কোন হাদীস প্রমাণ যোগ্য নয়। (তুহফাতুল আহওয়াযী:৩/৩৬৭)

❖ উল্লেখ্য, আল্লামা মুবারকপুরী আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মহামান্য ব্যক্তি, যিনি তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘‘তুহফাতুল আহওয়াযী’’ রচনা করেছেন। তিনি ঐ ব্যাখ্যাগ্রন্থেই এ মত উল্লেখ করেছেন। অথচ বর্তমান তথাকথিত আহলে হাদীসরা দাবী করছেন যে, এসব হাদীস নাকি ‘জাল’। এদেরই বিপক্ষে তাদের ইমামের উক্ত মন্তব্যটিই প্রমাণ করে যে, বর্তমান আহলে হাদীসগণ তাদের মান্যবরগণ কি বলছেন তাও খবর রাখেনা। 


✏ ০৩. সালাফীদের নয়নের শিরোমনী আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন-
مجموع الفتاوى (23/ 132)
وَأَمَّا لَيْلَةُ النِّصْفِ فَقَدْ رُوِيَ فِي فَضْلِهَا أَحَادِيثُ وَآثَارٌ وَنُقِلَ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْ السَّلَفِ أَنَّهُمْ كَانُوا يُصَلُّونَ فِيهَا 
فَصَلَاةُ الرَّجُلِ فِيهَا وَحْدَهُ قَدْ تَقَدَّمَهُ فِيهِ سَلَفٌ وَلَهُ فِيهِ حُجَّةٌ فَلَا يُنْكَرُ مِثْلُ هَذَا.
" এ রাতের ফজীলতে বেশ কিছু মরফূ হাদীস এবং আছার বর্ণিত আছে যে, প্রমাণ করে যে এ রাতটি ফজীলতপূর্ণ। পূর্ববর্তীদের কেউ কেউ এ রাতে বিশেষভাবে সালাত আদায় করতেন। ... যে মতের উপর আমাদের মাযহাবের বা অন্যান্য মাযহাবের বহু সংখ্যক বরং বেশিরভাগ আলেম রয়েছেন তা হলো এই রাতটি অন্যান্য রাতের উপর ফজীলত রাখে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর স্পষ্ট কথার মাধ্যমে এটিই জানা যায়। আর যেহেতু এ বিষয়ে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তীদের আমল সেসকল হাদীসকে সত্যায়ন করে। " (মাজমুউল ফাতাওয়া-২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪, ইক্তিদাউস সিরাত আল মুস্তাকিম-২/৬২৬,৬২৭,)।

✏ ০৪. আল্লামা ইবনে রযব হাম্বলী (রহ.) এর অভিমত-
وقال الحافظ ابن رجب الحنبلي رحمه الله تعالى في (لطائف المعارف:263):" وليلة النصف من شعبان: كان التابعون من أهل الشام يعظمونها ويجتهدون فيها في العبادة، وكان خالد بن معدان ولقمان بن عامر وغيرهما من تابعي الشام يقومون في المسجد ليلة النصف، ووافقهم الإمام إسحاق ابن راهويه على ذلك، وقال في قيامها في المساجد جماعة: ليس ذلك ببدعة "انتهى باختصار وتصرف.

শাবানের ১৫রজনীকে শামের (সিরিয়ার) তাবেয়ীগণ অনেক বড় মর্যাদারবান মনে করতেন। এর মাঝে ইবাদত নিয়ে অনেক মুজাহাদা করতেন। খালেদ ইবন মাদান ও লোকমান ইবনে আমের ইত্যাদি শামের (সিরিয়ার) তাবেয়ীগণ শাবানের ১৫রজনীতে মসজিদে অবস্থান করতেন..........। লাতায়েফুল মায়ারেফ-২৬৩।

✏ ০৫. শাইখ শুয়াইব আল আরনাউত এর অভিমত-
সময়কালীন বিশিষ্ট হাদীস পর্যালোচক শাইখ শুয়াইব আল আর নাউত মুসনাদে আহমদের টীকায় আব্দুল্লাহ বিন আমর (রঃ) কর্তৃক শবে বরাতের হাদীছটির উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন : " হাদীছটি তার সহযোগী হাদীছগুলো দ্বারা সহীহ বলে বিবেচিত। সহযোগী হাদীছগুলো হচ্ছে : 
১। আয়েশা (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ
২। মুআয বিন জাবাল (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ
৩। আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) এর হাদীছ
৪। আবু বকর (রঃ) এর হাদীছ
৫। আবু ছালাবাহ আল খুশানী (রঃ) এর হাদীছ
৬। আবু হুরায়রা (রঃ) এর হাদীছ
৭। আউফ বিন মালিক এর হাদীছ
এ সকল সহায়ক বা সমর্থক হাদীছের প্রত্যেকটির সূত্রের মধ্যে যদিও কিছু অসুবিধা আছে তবে এসব হাদীছের সমষ্টি দ্বারা মূল হাদীছ সহীহ ও শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং কাসেমী (রহঃ) হাদীছ পর্যালোচক ও সমালোচকদের থেকে ইসলাহুল মাসাজিদ গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন যে, মধ্য শা'বানের রাতের ফজীলত সম্পর্কে সহীহ হাদীছ নেই এর অর্থ হলো এ ব্যাপারে কোন হাদীছ সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নেই। কিন্তু সবগুলো হাদীছের সমষ্টিগত সূত্রের দ্বারা হাদীছগুলো পরস্পরে শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে বিষয়টি প্রমাণিত এতে কোন সন্দেহ নেই। " (মুসনাদে আহমদঃ খ-১১, পৃ-১৬, ৬৬৪২ )

✏ ০৬. আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) এর অভিমত-
মুহাদ্দিছুল আসর আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) বলেন :  " এ রাতটি (বরাতের রাত) এর ফজীলত সম্পর্কে সহীহ হাদীছসমূহে এসেছে। " ( আলারফুস শাযীঃ পৃ-১৫৬ )


✏ ০৭ আল্লামা ইমাম ইবনে ইসহাক বুরহান উদ্দিন ইবনে মুফলিহ এর অভিমত-
وَيُسْتَحَبُّ إِحْيَاءُ مَا بَيْنَ الْعِشَاءَيْنِ لِلْخَبَرِ.قَالَ جَمَاعَةٌ: وَلَيْلَةِ عَاشُورَاءَ، وَلَيْلَةِ أَوَّلِ رَجَبٍ، وَلَيْلَةِ نِصْفِ شَعْبَانَ، – المبدع شرح المقنع: ٢/٣٣ باب : صلوة التطوع-
-‘‘মুস্তাহাব হলো মাগরিব ও ইশার মাঝখানে এই সমস্ত রাত্রিগুলোতে জেগে ইবাদত করা। এক জামাত ইমামগণ বর্ণনা করেছেন, এই সমস্ত রাত্রি হল, আশুরার রাত্রি, রজবের প্রথম রাত্রি, এবং শাবানের ১৫ তারিখ (শবে বরাত) রাত্রি। এই সমস্ত রাত্রিতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। ’’মাবদাউ শরহে মাকানা: ২/৩৩পৃ.দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ,বয়রুত,লেবানন।

✏ ০৮ অন্যতম মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম যুরকানী (রহ.) এর অভিমত-
اذا كان ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها فقوموا ليلها" أي: أحيوه بالعبادة وانصبوا أقدامكم لله قانتين، 
-‘‘যখন ১৫ই শাবান আসবে তখন রাতে তোমরা ইবাদতের জন্য দন্ডায়মান হও। এবং এই ইবাদতের দ্বারা রাত্রকে জীবিত রাখ।’’শরহে মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ১০/৫৬১

✏ ০৯ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) এর অভিমত-
তিনি এক হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন- 
هذا الحديث بالباب الايذان بان ليلة النصف من شعبان لما ورد فى أحيائها من الثواب- باب: قيام شهر رمضان -
-‘‘এই হাদীসে অধ্যায়ের দ্বারা সংবাদ বা খবর দিয়েছে যে, শাবানের ১৫ই তারিখ রাতে (শবে বরাতে) জেগে ইবাদত করলে সাওয়াব রয়েছে যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।’’  মিরকাত : কিয়ামে রমযান: ৩/৩৪০, হাদিস- ১৩০০।

✏ ১০ আল্লামা তাহতাভী হানাফী এর অভিমত-
 وندب أحياء ليلة النصف من شعبان- 
-‘‘শবে বরাতে (১৫ই শাবান) রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব।’’ মারাকিল ফালাহ : পৃ-৩২৫।

✏ ১১ আল্লামা আলাউদ্দিন হাসকাফী এর অভিমত-
من المندوبات ركعتا السفر والقدوم منه وأحياء ليلتى العيدين والنصف من شعبان و العشر الاخير من رمضان والاول من ذى الحجة – 
-‘মুস্তাহাব হলো এ সমস্ত রাত্রিগুলোতে ইবাদত করা কমপক্ষে দুরাকাত নামায হলেও পড়া যেমন ১. সফরের প্রথম রাত ২. দুই ঈদের রাত ৩. শবেই বরাত (১৫ই শাবানের রাত) ৩. রমযানের শেষ দশ দিনের রাত জিলহজ্ব এর ১ম তারিখ।’’ দুররুল মুখতার : ২/২৪-২৫ পৃ কিতাবুল বিতর এবং নফল অধ্যায়

✏ ১২ আল্লামা ইবনে নুজাইজ হানাফী মিশরী এর অভিমত-
ومن المندوبات أحياء ليالى العشر من رمضان وليلتى العيدين ليالى عشر ذى الحجة وليلة النصف من شعبان كما وردت الاثار- 
-‘‘মুস্তাহাব হলো রমযানের শেষ দশ দিনের রাতে ও দুই ঈদের রাতে ইবাদত করা। জিলহজ্ব মাসের দশ রজনী এবং শবে বরাতের রাতে ইবাদত করা যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।’ বাহরুর রায়েক : ২/৫২ কিতাবুল বিতর ওয়ান নাওয়াফেল

✏ ১৩ বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শায়খ মনসূর বিন ইউনূস বাহুতী (রহ.) বলেন,
وفى استحباب قيامها أى ليلة النصف من شعبان ما فى أحياء ليلة العيد – (كشف القناع: ١/٤٢٠، باب: قبيل فصل سجدة التلاوة) -
‘‘শবে বরাত (১৫ শাবান) এর রাতে, দুই ঈদের রাতে দাড়িয়ে অর্থাৎ নামাযে লিপ্ত হওয়া মুস্তাহাব।’’ কাশফুল কানাঈ : ১/৪২০ : সিজদা ও তেলাওয়াতের ফযীলত অধ্যায়।

░▒▓█►এ বিষয়ে কতিপয় কিতাব◄█▓▒
 বহু মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাদের লিখনীর মাধ্যমে শবে বরাতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন ও তা নিয়ে লিখেছেন বিভিন্ন পুস্তিকাও যেমন-
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ‘‘ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭, ও আল্লামা তাকী ওসামনী (দা. বা.) এর শবে বরাআত কি হাকীকত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন