শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০১৫

শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রশংসা, সম্মান ও ভালোবাসার মাঝেও অতিরঞ্জন নিষেধ

শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রশংসা, সম্মান ও  ভালোবাসার মাঝেও অতিরঞ্জন নিষেধ
বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রশংসা, সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে, অনেকেই ইসলামের সীমারেখা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আসলে প্রকৃত পক্ষে ইসলাম এগুলো সমর্থন করে না। তাই আজকে এই বিষয়ে কিছু আলোচনা নিম্মে উল্লেখ করা হলো-


০১. একদা সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ভাবলেন আমরাতো দুনিয়াতে সমস্ত মুসলিমকেই সালাম করে থাকি, তাহলে আমরা আল্লাহকে সালাম করবো না কেন?
অতপর শুরু হলো মহান আল্লাহকেও সালাম করা। যার আলোচনা নিম্ম হাদীসে এসেছে-
صحيح البخاري (9/ 116)
7381 - حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، حَدَّثَنَا مُغِيرَةُ، حَدَّثَنَا شَقِيقُ بْنُ سَلَمَةَ، قَالَ: قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: كُنَّا نُصَلِّي خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَقُولُ: السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " إِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّلاَمُ، وَلَكِنْ قُولُوا: التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ، السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ "

হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল (সা.) এর পিছনে নামায আদায় করছিলাম। অতঃপর আমরা নামাযের মাঝে (আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতি লক্ষ্য করে) বললাম : ‘‘السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ’’ (আল্লাহর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তাদের এই ধরনের ভালোবাসার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে) বললেন, ‘‘إِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّلاَمُ’’ নিশ্চয় আল্লাহ নিজেই শান্তি বর্ষনকারী। (তোমরা এভাবে না বলে) এমন ভাবে বল- ‘‘ التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ، السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ’’  (সম্পূর্ণ আত্তাহিয়্যাতু তখন শিক্ষা দেয়া হয়)। বুখারী-৯/১১৬, হাদীস-৭৩৮১।

প্রিয় পাঠক! দেখুন, উল্লেখিত হাদীসের মাঝে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে, ‘‘সালাম’’ দেয়া শুরু করেছেন। অথচ তা শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা তা মাখলুক তথা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খালেক তথা স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই আমাদেরও এধরনের আচরণ থেকে বাঁচা উচিৎ।
 
০২. তেমনি ভাবে রাসূল (সা.) এর প্রতি অবাধ ভালোবাসার দরুন হযরত সাদ (রা.)  রাসূল (সা.) কে সেজদা করা ও রাসূল (সা.) এ ধরনের ভালোবাসা থেকে বাঁধা প্রধান করার ইতিহাস-
سنن ابن ماجه (1/ 595)
1853 - حَدَّثَنَا أَزْهَرُ بْنُ مَرْوَانَ، قَالَ: حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنِ الْقَاسِمِ الشَّيْبَانِيِّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي أَوْفَى، قَالَ: لَمَّا قَدِمَ مُعَاذٌ مِنَ الشَّامِ سَجَدَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَا هَذَا يَا مُعَاذُ؟» قَالَ: أَتَيْتُ الشَّامَ فَوَافَقْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِأَسَاقِفَتِهِمْ وَبَطَارِقَتِهِمْ، فَوَدِدْتُ فِي نَفْسِي أَنْ نَفْعَلَ ذَلِكَ بِكَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَلَا تَفْعَلُوا، فَإِنِّي لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِغَيْرِ اللَّهِ، لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا، وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا تُؤَدِّي الْمَرْأَةُ حَقَّ رَبِّهَا حَتَّى تُؤَدِّيَ حَقَّ زَوْجِهَا، وَلَوْ سَأَلَهَا نَفْسَهَا وَهِيَ عَلَى قَتَبٍ لَمْ تَمْنَعْهُ»
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুয়ায (রা.) যখন সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন। তখন তিনি নবী (সা.) কে সেজদা করেন। নবী (সা.) বললেন, হে মুয়ায! এটা কি? তিনি বললেন : আমি সিরিয়া গিয়ে দেখেছি, তথাকার লোকজন তাদের নেতাদের সেজদা করে। তাই আমি মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করেছি যে, আমি আপনার সঙ্গে এরূপ করবো। রাসূল (সা.) বললেন : তোমরা এরূপ করবে না। আমি যদি কাউকে আদেশ দিতাম যে, সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সেজদা করে, তাহলে আমি অবশ্যই স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম, সে যেন তার স্বামীকে সেজদা করে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, স্ত্রী ততক্ষন তার রবের হক আদায় করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের স্বামীর হক আদায় করে। স্বামী যদি স্ত্রীকে কাছে পেতে চায়, আর সে পালং এর উপরেও থাকে, তখনও সে তাকে নিষেধ করবে না। ইবনে মাজা-১/৫৯৫, হাদীস-১৮৫৩। হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে তার মধ্য থেকে সহীহ লি গায়রিহী সনদেও রয়েছে, যা প্রমাণযোগ্য।
 
প্রিয় পাঠক! উক্ত হাদীস এর মাঝেও রাসূল (সা.) এর প্রতি অধিক ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে, ইসলামের বাহিরে চলে যাওয়ায় রাসূল (সা.) হযরত মুয়ায (রা.) কে বাঁধা প্রধান করেছেন। তাই আমরাও এগুলো থেকে বিরত থাকবো।

০৩. তিরমিযী শরীফের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে-
سنن الترمذي ت شاكر (3/ 391)
1090 - حَدَّثَنَا حُمَيْدُ بْنُ مَسْعَدَةَ البَصْرِيُّ قَالَ: حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ المُفَضَّلِ قَالَ: حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ ذَكْوَانَ، عَنْ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذٍ قَالَتْ: جَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَدَخَلَ عَلَيَّ غَدَاةَ بُنِيَ بِي، فَجَلَسَ عَلَى فِرَاشِي، كَمَجْلِسِكَ مِنِّي، وَجُوَيْرِيَاتٌ لَنَا يَضْرِبْنَ بِدُفُوفِهِنَّ، وَيَنْدُبْنَ مَنْ قُتِلَ مِنْ آبَائِي يَوْمَ بَدْرٍ، إِلَى أَنْ قَالَتْ إِحْدَاهُنَّ: وَفِينَا نَبِيٌّ يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «اسْكُتِي عَنْ هَذِهِ، وَقُولِي الَّتِي كُنْتِ تَقُولِينَ قَبْلَهَا». هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ

 হযরত মুআওব্বিয এর কণ্যা রুবাই (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) আমার বাসর রাতের সকালে আমার ঘরে এলেন। আমার কাছে তুমি (খালিদ ইবনু যাকওয়ান) যেভাবে বসে আছো, তিনি আমার বিছানায় ঠিক সেভাবে বসলেন। আমাদের বালিকারা এমন সময়ে দফ বাজিয়ে বদরের যুদ্ধের শহীদ হওয়া আমার বাপ-দাদার শোকগাঁথা গাইছিলো। তাদের কোন একজন গাইতে গাইতে বলল, ‘‘আমাদের মাঝে একজন নবী আছেন। আগামী কাল কী হবে তা তিনি জানেন।’’ রাসূল (সা.) তাকে বললেন : এরূপ বলা হতে বিরত থাক, বরং তাই বল এতক্ষণ যা বলছিলে।’’ তিরমিযী-৩/৩৯১, হাদীস-১০৯০। হাদীসটি সহীহ

প্রিয় পাঠক! দেখুন, উক্ত হাদীসটির মাঝেও রাসূল (সা.) এর শানে অধিক ভালোবাসায় বলছিলো যে ‘‘তিনি আগামী কাল কী হবে তা জানেন’’ রাসূল (সা.) সাথে সাথে এ কথার মাঝে বাঁধা প্রধান করলেন। তাই আমরাও ভালোবাসার দরুন এধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকবো।

০৪. তেমনিভাবে সহীহ বুখারী শরীফের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে-
 صحيح البخاري (2/ 39)
1063 - حَدَّثَنَا أَبُو مَعْمَرٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ الوَارِثِ، قَالَ: حَدَّثَنَا يُونُسُ، عَنِ الحَسَنِ، عَنْ أَبِي بَكْرَةَ، قَالَ: خَسَفَتِ الشَّمْسُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَخَرَجَ يَجُرُّ رِدَاءَهُ، حَتَّى انْتَهَى إِلَى المَسْجِدِ وَثَابَ النَّاسُ إِلَيْهِ، فَصَلَّى بِهِمْ رَكْعَتَيْنِ، فَانْجَلَتِ الشَّمْسُ، فَقَالَ: «إِنَّ الشَّمْسَ وَالقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ، وَإِنَّهُمَا لاَ يَخْسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ، وَإِذَا كَانَ ذَاكَ فَصَلُّوا وَادْعُوا حَتَّى يُكْشَفَ مَا بِكُمْ» وَذَاكَ أَنَّ ابْنًا لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ فَقَالَ النَّاسُ فِي ذَاكَ
হযরত আবী বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সময় সুর্যগ্রহণ হল। তিনি বের হয়ে তাঁর চাঁদর টেনে মসজিদে পৌঁছলেন এবং লোকজনও তার কাছে একত্রিত হল। তারপর তিনি তাদের নিয়ে দু’রাকআত সালাত আদায় করেন। এরপর সূর্যগ্রহণ মুক্ত হলে তিনি বললেন : সুর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শন সমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যুর কারণে এ দুটোর গ্রহণ ঘটে না। কাজেই যখন গ্রহণ হবে তা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করবে এবং দুআ করতে থাকবে। এ কথা নবী (সা.) এ কারণেই বলেছেন যে, সেদিন তার পুত্র ইবরাহীম (রা.) এর ওফাত তথা মৃত্যু হয়েছিল এবং লোকেরা সে ব্যাপারে বলাবলি করছিল। বুখারী-২/৩৯, হাদীস-১০৬৩।

প্রিয় পাঠক! উক্ত হাদীসটির মাঝেও সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.) এর পুত্র ইবরাহীম (রা.) এর প্রতি অধিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকার দরুন, সুর্যগ্রহণ হয়েছে বলে ধারণা করেছেন। কিন্তু তা ছিল ভুল। তাই রাসূল (সা.) বিষয়টিকে স্পষ্ট করে, তাদের ভুল ধারণাকে দূর করে দিলেন ।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রশংসা, সম্মান ও ভালোবাসা ইত্যাদির মাঝে অতিরঞ্জন থেকে হেফাযত করুন এবং কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রশংসা ও ভালোবাসার তাওফীক দান করুন। আমীন

ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন