শুক্রবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৫

বিদ‘আহ! বিদ‘আহ! বিদ‘আহ! সকল ঈদের সেরা ঈদ রাসূলের জন্ম ঈদ!!!

সকল ঈদের সেরা ঈদ রাসূলের জন্ম ঈদ!!!

(সারসংক্ষেপ, যারা বিস্তারিত পড়তে আগ্রহী নন)
     ঈদে মিলাদুন নবী পালন করা হলো বেদআত, কারন সাহাবী ও রাসূল (সাঃ) থেকে এ সম্পর্কে কোন বণনা নেই। মোট কথা কোরআন ও হাদীসে এর সপক্ষে কোন বিধান নেই। আর এগুলো হলো বিজাতীয় স্বাভাব যা প্ররিত্যাগ করা আমাদের জন্য আবশ্যক। তাছাড়াও ইসলামী শরী‘আতে দুটিমাত্র ঈদ পাওয়া যায়। তাহলে এখন তৃতীয় ঈদ কোথা থেকে আসলো? নিশ্চয় বিদ‘আতীদের পক্ষ থেকে।
     আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন আমীন।
 

বিস্তারিত দেখুন-

হিজরী সনের রবিউল আওয়াল মাস আসতেই শুরু হয় এক অদ্ভুত কান্ড, এক শ্রেণীর মুসলমানরা যেন ইবাদাতের মাস হিসাবে শুধু এ মাসটিকেই চেনে, শুধু তাই নয় বরং তাদের তথা কথিত মরিচাপূর্ণ ধ্যান-ধারণায় এ মাসটিই হলো ইবাদাতের সর্বোচ্চ বড় মৌসুম। এমনকি নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কর্তৃক ঘোষিত মুসলমানদের একমাত্র দুটি ঈদ- তথা ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আযহাও তাদের কাছে হার মেনেছে। তাইতো তাদের ঘোষিত ও লিখিত শ্লোগান- “সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মিলাদুন্নাবী” (নাউযুবিল্লাহ)। ভারতীয় উপমহাদেশে এক শ্রেণীর মুসলিমদের মাঝে ১২ই রবিউল আওয়াল এলে শুরু হয়ে যায় এক এলাহী কান্ড। অথচ আমরা স্মরণ করিনা সেই মক্কা-মদীনার কথা, যেখানে নবী (সাঃ)-এর জীবন অতিবাহিত হয়েছে এবং যেখানে তিনি সমাধিত হয়েছেন। একি আশ্চর্যের বিষয়! প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোন! আল্লাহ আমাদেরকে রহম করুন! আসুন আমরা কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে “ঈদে মিলাদুন্নাবী ইবাদাত না বিদআত? জেনে নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ

“ওহে যারা ঈমান এনেছ তোমরা আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কর এবং রাসূল (সাঃ)-এর অনুস্মরণ কর আর তোমাদের আমলসমূহ নষ্ট করে ফেল না। (সূরা মুহাম্মদঃ ৩৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ

যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতদ্বন্দ্বে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ এবং রাসূলের দিক ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক।” (সূরা নিসাঃ ৫৯)
ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ) আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ

فدل على أن من لم يتحاكم فى محل النزاع إلى الكتاب والسنة ولايرجع إليهما فى ذلك فليس مؤمنا بالله ولاباليوم الاخرة

আয়াতে প্রামাণিত হয়, যে ব্যক্তি মতদ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর ফায়সালা গ্রহণ করবে না এবং সে দুটির (মতের) প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে না সে আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী বা ঈমানদার নয়। (তাফসীর ইবনে কাছীর ১/৫৬৮) 

বিদআতের পরিচয়ঃ

     بدعة (বিদআত) শব্দটি আরবী হওয়া সত্ত্বেও সকল ভাষাভাষী মুসলিম সমাজে পরিচিত এ জন্য যে, শব্দটি ইসলামে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অনেকেই “বিদআত” পরিভাষাটির সঠিক ব্যাখ্যা না জানার কারণে বিদআতীদের ধোকা হতে রেহাই পাচ্ছেনা’।
     بدعة (বিদআত) শব্দটি بدع মূল শব্দ হতে নির্গত যায় শাব্দিক অর্থ হলো নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন। এ শব্দটি পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ

بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ

“আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের কোন দৃষ্টান্ত ছাড়াই আসমান ও যমিনের আবিষ্কার করেছেন।” (সূরা বাকারাঃ ১১৭)
তাই বিদআতের সংজ্ঞায় বলা হয়ঃ

الاختراع على غيرمثال سابق

অর্থাৎ পূর্বের কোন দৃষ্টান্ত বা নমুনা ছাড়াই কোন কিছুর উদ্ভব ঘটানো। সুতরাং বিদআত বা নব আবিষ্কার দু’প্রকার হতে পারে, এক. পার্থিব জীবনের উন্নয়নের নব আবিষ্কার, দুই. ইবাদাতের নামে ইসলামে কোন কথা বা কাজের নব আবিষ্কার। এ প্রকারই নিষিদ্ধ তাই ইসলামী পরিভাষায় বিদআতের সংজ্ঞা হলোঃ

ما أحدث فى الدين على خلاف ما كان عليه النبى صلى الله عليه وسلم وأصحابه من عقيدة أوعمل

ইসলামে এমন কোন আকীদা বিশ্বাস বা আমল এর উদ্ভব ঘটানো যা নবী (সা) ও সাহাবায়ে কিরামদের মাঝে ছিল না। (আল বিদা ওয়াল মুহদাছাতঃ ৯৭)
    মোট কথা, ইসলামে ইবাদাতের নামে এমন কোন কথা বা কাজ আবিষ্কার করা যা কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই। এ বিদআতকে বুঝানোর ক্ষেত্রে অনেকে অনেক ভাবে বিভক্ত করেছেন যেমন, কথার বিদআত, কাজের বিদআত, আকীদা বিশ্বাসে বিদআত ইত্যাদি। কিন্তু হুকুমের বা বৈধ ও অবৈধ এবং শেষ পরিণতির দিক দিয়ে এর কোন প্রকার প্রভেদ নেই। সবই হারাম বা নিষিদ্ধ। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ

إياكم ومحدثات الامور فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة

“তোমরা যাবতীয় নতুন আবিষ্কার হতে সাবধান, কেননা ইসলামে প্রতিটি নতুন আবিষ্কারই হলো বিদআত আর প্রতিটি বিদআতই হলো পথভ্রষ্টতা বা গুমরাহী। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, নাসাঈ ও আহমাদ সহীহ আল জামি‘ হাঃ ২৫৪৬।
আর পথভ্রষ্টতা বা গুমরাহী নিয়ে যায় জাহান্নামে। তাই ইসলামে বিদআতে হাসানা (ভাল বিদআত) ও বিদআতে সাইয়েয়াহ (খারাপ বিদআত) এরূপ কোন ভাগাভাগির সুযোগ নেই। সকল প্রকার বিদআতই প্রত্যাখানযোগ্য কোন বিদআতী আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। নবী (সাঃ) বলেনঃ

من أحدث فى أمرنا هذا ماليس منه فهو رد

“যে আমাদের দীনে এমন কিছু উদ্ভাবন করল যা তাতে ছিলনা তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী, মুসলিম)

পরিশেষে বলতে পারি কুরআন ও সহীহ হাদীসে প্রমাণিত নয় এমন ইবাদাতের নামই হলো বিদাআত, যা আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করবেনই না উপরন্ত এ সব বিদআত বিদআতীকে হিদায়াত থেকে গুমরাহী এবং জান্নাত হতে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।

“ঈদে মিলাদুন্নাবীর” কথা, তা ইবাদাত না বিদআত?

     ঈদে মিলাদুন্নাবীঃ “ঈদে মিলাদুন্নাবী” একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। এ নামটি তিনটি আরবী শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, শব্দ তিনটি হলো ঃ عيد (ঈদ), ميلاد (মিলাদ) النبى (নাবী)।
     عيد (ঈদ) শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো বারংবার ফিরে আসা, সমবেত হওয়া, আনন্দ উৎসব ইত্যাদি।
পরিভাষায় ঈদ হলো, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেনঃ

العيد اسم لما يعود من الاجتماع على وجه معتاد عائد، إما بعود ألسنة أوبعود الأسبوع أو الشهر أونحوذالك

“ঈদ হচ্ছে এমন সাধারণ সমাবেশ যা নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসে, বছর ঘুরে আসে, অথবা মাসে আসে।’ (আল আইয়াদ ওয়া আছারুহা আলাল মুসলিমিনঃ ২১)
     এ ঈদ সময় কেন্দ্রিক আবার স্থান কেন্দ্রিকও হয়ে থাকে। ميلاد (মিলাদ) অর্থ জন্ম, অর্থাৎ জন্ম দিবস, আর النبى (নাবী) শব্দটি আরবী হলেও তা সকল মুসলিমের বোধগম্য। উদ্দেশ্য হল নবী মুহাম্মদ (সা)। সুতরাং “ঈদে মিলাদুন্নাবী” এর অর্থ হলো ঃ নবীর জন্মে খুশী বা উৎসব। নবী মুহাম্মদ (সা) এর জন্ম উপলক্ষে যে আনুষ্ঠাতিকতা বা ঈদ উৎসব পালন করা হয় তাকে “ঈদে মিলাদুন্নাবী” বলা হয়। এখন প্রশ্ন জাগে যে, ঈদে মিলাদুন্নাবী” এর উৎপত্তি কখন হতে?

ঈদে মিলাদুন্নাবী এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশঃ


“ঈদে মিলাদুন্নাবী” এ জাতীয় অনুষ্ঠানাদির ভিত্তি কুরআন ও সহীহ হাদীসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যায় প্রাক ইসলামী যুগেও এ জাতীয় আচার অনুষ্ঠান ছিল, যেমন- গ্রীক, ইউনান, ফিরায়ানা ইত্যাদি সভ্যতায় তারা স্বীয় দেবতার অনুষ্ঠান উদযাপন করত। তাদের থেকে গ্রহণ করেছে পরবর্তী খ্রীষ্টান সম্প্রদায়। যাদের কাছে বড় ঈদ হলো তাদের নবীর জন্মোৎসব পালন করা। খ্রীষ্টানদের জন্মোৎসব বা বড় দিবসের অনুষ্ঠান শুধু প্রাক ইসলামেই পালন করা হত না বরং আজও হয়ে চলছে, সেখান থেকেই অনুসৃত হয়ে এসেছে এক শ্রেণীর মুসলিম সমাজে। এখন প্রশ্ন হলো, কখন থেকে মুসলিম সমাজে এ অনৈসলামিক সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটল এবং কার মাধ্যমে ঘটল?

সর্ব প্রথম ঈদে মিলাদুন্নাবী উদযাপনঃ

ঈদে মিলাদুন্নাবী এর পক্ষে ও বিপক্ষে সকল আলিম সমাজ একমত যে, এই মিলাদুন্নাবীর উৎসব নবী (সা), সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনদের মাধ্যমে কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে অবশ্যই সে উত্তম যুগ সমূহ অতিবাহিত হওয়ার পরই এ বিদআতের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু কোন সময় এবং কার মাধ্যমে এ বিদআতের উদ্ভব ঘটল এ নিয়ে ইসলামী পন্ডিতগণ দু’টিমত ব্যক্ত করেছেন।
একঃ হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে মিসরে ফাতেমী সম্রাজ্যে এ বিদআতের উদ্ভব ঘটে। তারা সর্বপ্রথম ছয় জন ব্যক্তির জন্মোৎসব পালন করেন। (১) নবী (সাঃ) (২) আলী (রাঃ) (৩) হাসান (রাঃ) (৪) হুসাইন (রাঃ) (৫) ফাতেমা (রাঃ) (৬) তৎকালীন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের খলীফা। তখন হতে ফাতেমী বা শিয়া সম্প্রদায়ের খলীফা স্বউদ্যোগে জাতীয়ভাবে ছয় জনের জন্ম দিবস পালন করত। [দ্রঃ আল খিতাত লিল মাকরীযী- ১/৪৯০-৪৯৯)
দুইঃ হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরাকের মাওসুল শহরে তৎকালীন বাদশা আল মুযাফফার এর পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী আলেম ওমার বিন মুহাম্মদ মল্লা এর পরিচালনায় সর্ব প্রথম নবী (সা) এর জন্ম বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। (হাসনুল মাকসাদ লিসযুয়ূতীঃ ৪২ পৃষ্ঠা) (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াঃ ১৩/১৪৭ পৃষ্ঠা)
     ইমাম আবু শামাহ (রহঃ) উক্ত দুটি মতের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে বলেনঃ বস্তুতঃ সর্বপ্রথম যারা এ বিদআতের উদ্ভাব ঘটায় তারা হল ফাতেমী বা শিয়া সম্প্রদায়। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা মিসরের রাজধানী কায়রোতে এ বিদআতের আবির্ভাব ঘটায়। অতঃপর সেখান থেকে ফাতেমী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লে ইরাকের মধ্যে মাওসুল শহরে সর্বপ্রথম বাদশা মুযাফ্ফর এর পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিদআত চালু হয়। যদিও অন্যাঞ্চলে তা আগেই উদ্ভব হয়েছিল কিন্তু ইরাকের মওসুল শহরে তার মাধ্যমেই প্রথম চালু হয়। (আল-বায়িছ লিআবী শামাহঃ ২৩-২৪ পৃষ্ঠা)। বিস্তারিত দ্রঃ (আল আইয়াদ ওয়া আছারুহু আলাল মুসলিমিন ২৮৬-২৮৯ পৃষ্ঠা)
একটু চিন্তা করুনঃ
     প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন, যে কাজটি নবী (সাঃ)-এর যুগে ছিলনা, সাহাবায়ে কিরামদের যুগে ছিল না, এমনকি তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও প্রসিদ্ধ ইমামদের যুগেও ছিলনা তা কিভাবে ইসলামের ইবাদাত হতে পারে? সত্য ইতিহাস প্রমাণ করছে এ বিদআতের উদ্ভব হলো নবী (সাঃ) এর পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার চারশত বছরেরও অনেক পরে। তাই বিদআতের সঠিক মাপকাঠিতে ফেলে একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইহা একটি সুন্নী মুসলিমদের আজীবন শত্র“ ভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায় হতে উদ্ভাবিত এক ভ্রান্ত গুমরাহি বিদআত যা নবী (সা) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামদের আমলে ছিলনা। আসুন আমরা এ প্রচলিত বিদআত নবী (সা) এর জন্মবার্ষিকী প্রচলন উপলক্ষে যে সব গর্হিত ও ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত হয় তার সামান্য কিছু লক্ষ্য করি এবং কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই।

ঈদে মিলাদুন্নাবীকে কেন্দ্র করে যা হয়ে থাকেঃ

     আমরা জানলাম ঈদে মিলাদুন্নাবী ইবাদাতের নামে একটি নব উদ্ভাবিত বিদআত। কিন্তু ইহা কি শুধু বিদআতের সীমায় সীমিত না একে কেন্দ্র করে আরো কিছু হয়ে থাকে? উত্তরে নির্বিঘেœ বলতে পারি যে, ইহা স্বীয় সীমানায় সীমিত নয়, বরং এ মিলাদুন্নাবীকে কেন্দ্র করে মানুষ লিপ্ত হয় পৃথিবীর বুকে সর্বনিকৃষ্ট ও জঘন্যতম অপরাধে যা আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করেন না, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَاء

“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তার সাথে অংশী স্থাপনের অপরাধ ক্ষমা করেন না, আর এ অপরাধ ছাড়া তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তার অপরাধ ক্ষমা করে দেন” (সূরা নিসা ঃ ৪৮)
ইহা শুধু অপরাধ বলেই গণ্য হয় না বরং এ অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে তার অতীতের সর্বপ্রকার সৎকর্ম বিনাশ হয়ে যায় এবং সে ইসলাম হতে বের হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَلَوْ أَشْرَكُواْ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

“আর যদি তারা শির্কে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের অতীতের সব আমল বিনাশ হয়ে যাবে। (সূরা আনআমঃ ৮৮)

নাবী (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী পালনে মানুষ এমন কর্মে লিপ্ত হয় যা প্রকাশ্য শির্ক যেমনঃ

     তাদের বিশ্বাস হলো নবী (সাঃ) মানব নন তিনি নূরের তৈরী, তিনি গায়েব জানেন। তিনি সর্বত্র উপস্থিত হয়ে থাকেন, এমন কি সে দিশেহারা নির্বোধেরা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নবী (সা) এর কাছেই তাদের ফরিয়াদ পেশ করে, তার কাছে তলব করে সাহায্য সহযোগিতা, ইত্যাদি ভাবে নবী (সা) কে আল্লাহ তাআলার সমপর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এ দিশেহারা ভ্রান্ত মুসলিম সমাজের অবস্থা কি সেই ভ্রান্ত খ্রীষ্টান বা নাসারাদের মত নয়? যারা তাদের নবী ঈসা (আ) কে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহর সমপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। তাইতো শুরুতেই বলেছিলাম যে, খ্রীষ্টানেরা তাদের নবীর জন্মবার্ষিকী পেয়েছে ইউনান গ্রীকদের কাছ থেকে আর এ শ্রেণীর মুসলিম সমাজ তাদের নবীর জন্ম বার্ষিকী পেয়েছে সেই ভ্রান্ত খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে, যার শেষ রূপ খ্রীষ্টানদের ঈসা (আ) কে মাবুদ বানানোর মতই হয়ে গেছে। তাইত নবী মুহাম্মদ (সা) স্বীয় উম্মতকে সতর্কবাণী করে গেছেন চৌদ্দশত বছর পূর্বেই, তিনি (সা) বলেনঃ

لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ، وَرَسُولُهُ

“তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা যেমন খ্রীষ্টানেরা ঈসা ইবনে মারয়াম এর ব্যাপারে (তাকে মাবুদের পর্যায় পৌঁছিয়ে) বাড়াবাড়ি করেছে, আমি কেবলমাত্র একজন বান্দা (আল্লাহর দাস) অতএব তোমরা আমাকে বল আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল।” (সহীহুল বুখারী হাদীস নং ৩৪৪৫)
এছাড়াও সে সমস্ত অনুষ্ঠানাদিতে যে নাত, ছন্দ ও ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যে গুলোর অনেকাংশ শির্কি কথা বার্তায় পৌঁছে যায়, যা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছেনা। অনুরূপ ঈদে মিলাদুন্নাবীকে কেন্দ্র করে মাজার ও দরগাসমূহে যে সব ওরোসের আয়োজন হয়ে থাকে, যে গুলোতে গর্হিত কার্যকলাপই ভরপুর, সেখানে গাঁজাখোরদের আড্ডা, গান বাজনার আসর, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি। একজন ধর্মপ্রিয় বিবেকবান ব্যক্তির কাছে আর বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা, কিভাবে এ গর্হিত কাজ ইসলামের ইবাদাত হতে পারে? কিন্তু সমস্যা হলো সাধারণ মুসলিম সমাজ তথাকথিত বিদআতী আলিম সমাজের ভ্রান্ত বিবৃতির সংশয়ে পড়ে গেছেন। তাই আসুন কিছু সংশয় নিরসনে যাই।
সংশয় নিরসনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ كل حزب بما لديهم فرحون “প্রতিটি দলই নিজেকে নিয়ে আনন্দে উৎফুল্ল্য” (সূরা রুম ঃ ৩২) এটাই হলো মানব জাতির স্বভাব তাইতো দেখা যায় যাদের ধর্মের বিকৃত রূপ ছাড়া সত্যতার কোন বালাই নেই, সেই ইয়াহুদ খ্রীষ্টানেরাও নিজেদের ধর্মের সঠিকতা দাবী করে এবং সাধারণ মানুষকে স্বীয় ধর্মে ভিড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি ঈদে মিলাদুন্নাবীর মত বিদআতকে এক শ্রেণীর মানুষ ইবাদাতে পরিণত করার অপতৎপরতায় মেতে উঠেছে এবং কুরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যার সাথে মিথ্যা ও জাল প্রমাণের আশ্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে সংশয়ে ফেলেছে। আসুন আমরা সে সব অসারতা ও সংশয়ের নিরসনে যাই।
প্রথম সংশয়ঃ নবী (সাঃ) এর মুহাব্বত বা ভালবাসার দোহাই দিয়ে এ সব কাজ করা হয় এবং বলা হয় যে, যারা এ মিলাদ পালন করে না তারা নবী (সা) কে ভালবাসে না।
     এ সংশয়ের নিরসনে বলতে চাই, নবী (সাঃ)-কে ভালবাসার অর্থ কি তাঁর আদেশ-নিষেধ সমূহ মেনে চলা, না প্রবৃত্তির অনুসরণ করে দীন পালন করা? সঠিক উত্তর হলো তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা এবং তাঁর পূর্ণ অনুসরণ করা। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো, নবী (সা) এ ধরনের আনন্দ, উল্লাস ও আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নাবী পালন করার কোন আদেশ বা অনুমতি দিয়েছেন এর কোন সঠিক প্রমাণ আছে কি? আদৌও নেই। আরো প্রশ্ন হল তথাকথিত ভালবাসার দাবীদাররা নবী (সা) কে বেশী ভালবাসেন, না সে সব সাহাবায়ে কিরাম যাঁরা তার কথায়, আদেশ নিষেধ পালনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন? উত্তর হলো তারাই (সাহাবীগণ) নবী (সাঃ)-কে বেশী ভালবেসে ছিলেন যার, কোন তুলনা হতে পারে না।
     অতএব, সাহাবীগণ এ উম্মাতের সর্বত্তোম নবীর (সাঃ) অনুসারী এবং সর্বত্তোম নবী প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও তারা কি এ জাতীয় মিলাদ মাহফিলের উদযাপন করেছেন? কখনই না। সুতরাং এসব ভালবাসার দাবী প্রবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া কখনও নবী (সা) এর অনুসরণ হতে পারে না। বরং যারা এসব বিদআত বর্জন করে চলেন তারাই প্রকৃত নবী প্রেমিক এবং তাঁর অনুসারী।
দ্বিতীয় সংশয়ঃ বলা হয় যে, “আবূ লাহাব এর মৃত্যুর পর তাকে স্বপ্নে দেখলে জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার অবস্থা কিরূপ? তিনি বলেন ঃ আমার দাসী শুয়াইবা নবী (সাঃ)-এর জন্মের সুসংবাদ দিলে তাঁকে দুধ পানের জন্য আমি তাকে (দাসীকে) আযাদ করে দিই তাই প্রতি সোমবার আমার জাহান্নামের আযাব হালকা করে দেয়া হয় এবং আমার দু’আঙুলের মাঝ হতে প্রবাহিত পানি পান করতে পারি।” দাবী হলো আবু লাহাব একজন কাফির হওয়া সত্বেও নবী (সা) এর জন্মের খবর পেয়ে তার দাসীকে মুক্তি করে দেয়াতে যদি উক্ত প্রতিদান পায়, তাহলে আমরা মুসলমান হয়ে যদি নবীর (সা) জন্ম দিবস পালন করতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিদান রয়েছে।

সংশয় নিরসন ও তার জবাবঃ

     প্রথমতঃ এ ঘটনাটি মুরসাল সূত্রে প্রমাণিত, যা হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী- যয়ীফ বা দুর্বল শ্রেণীভুক্ত এবং দলীল হিসাবে অগ্রহণযোগ্য।
     দ্বিতীয়তঃ বিশুদ্ধ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, আবু লাহাব তার দাসীকে নাবী (সা) এর মদীনায় হিজরতের প্রারম্ভে আযাদ করেন, যা নবী (সা) এর জন্মের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর। (দ্রঃ তরকাত লি ইবনে সা‘দ ১/১০৮-১০৯, ও আল ইসবাহ লি ইবনে হাজার ৪/২৫৮) ইহা প্রমাণ করে যে উক্ত ঘটনাটি সঠিক নয়।
     তৃতীয়তঃ কুরআনুল কারীমের অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করছে যে, আবু লাহাবের মতো কাফিররা জাহান্নামী হবে এবং তাদের জাহান্নামের আযাব কোন রূপ কম করা হবেনা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَى عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا كَذَلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ

“তাদের জন্য হলো জাহান্নামের আযাব, আর এ আযাব ভোগকালে তাদের কোন মৃত্যুও হবেনা এবং জাহান্নামের আযাব তাদের জন্য হালকাও করা হবে না। এরূপই আমি প্রতিটি কাফিরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা ফাতিরঃ ৩৬)। আল্লাহ তাআলার কথা হলো কাফিরদের কোন আযাব হালকা করা হবেনা, আর উক্ত ঘটনা প্রমাণ করে আবু লাহাবের আযাব হালকা করা হবে, সুতরাং উক্ত ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হতে আর কী বাকী থাকে।
তৃতীয় সংশয়ঃ সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে নবী (সা) কে সোমবারের রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ “সোমবারে আমি জন্ম লাভ করেছি এবং সোমবারেই আমি নবুয়াতপ্রাপ্ত হয়েছি।” ঈদে মিলাদুন্নবীর দাবীদাররা বলেন যে, নবী (সা) নিজেই তাঁর জন্ম দিনকে রোযা ইবাদাতের মাধ্যমে পালন করেছেন, তাই নবী (সা) এর জন্ম দিন পালন করা তাঁর সুন্নাত।
এ অপব্যাখ্যার জবাবে আমরা বলতে চাই- 
     প্রথমতঃ নবী (সা) সোমবারকে তার জন্ম দিন হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং সেদিন রোযা রেখেছেন, তিনি ১২ ই রবিউল আওয়ালকে জন্ম দিন হিসাবে বলেননি এবং ঐ তারিখে এ উদ্দেশ্যে কোন রোযা রেখেছেন তার কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং যারা আজ ১২ই রবিউল আওয়ালকে নবীর (সা) জন্ম দিবস হিসাবে পালন করেন এবং ঐ হাদীস এর দলীল পেশ করেন, তারা হয় হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে অজ্ঞ অথবা হাদীসের অপব্যাখ্যাকারী, প্রবৃত্তির পূজারী ছাড়া কিছুই নন।
     দ্বিতীয়তঃ নবী (সা) সোমবারের রোযা জন্ম দিনের জন্য রাখেন নি বরং আরো অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কারণে রাখতেন তিনি বলেনঃ প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলসমূহ উপস্থাপন করা হয় তাই আমার পছন্দ হয় যে, আমি রোযা অবস্থায় আমার আমল উপস্থাপন করা হোক।” (তিরমিযী, আবু দাউদ সহীহ)। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, নবী (সা) অন্য কারণেই সোমবার রোযা রাখতেন।
     তৃতীয়তঃ যারা নবী (সা) এর সোমবার জন্ম দিবস হিসাবে রোযা রাখার দলীল দিয়ে তাদের কু-মতলব হাসিল করতে চান, তাদের বলতে চাই যে, নবী (সা) তাঁর জন্ম দিন সোমবার রোযা রাখার মাধ্যমে পালন করেছেন? না খাওয়া দাওয়া ও আনন্দ উল্লাস এবং অনুষ্ঠান উদযাপনের মাধ্যমে পালন করেছেন? উত্তর হলো রোযা রাখার মাধ্যমে, পক্ষান্তরে সুবিধাবাদী জিন্দাবাদেরা তাঁর বিপরীত। আরো প্রশ্ন হলো নবী (সা) কি বছরে শুধু একটি দিন উদযাপন করেছেন না প্রতি সপ্তাহে? প্রশ্নঃ সাহাবায়ে কিরাম কি রোযা রাখার মাধ্যমে নবী (সা) এর প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা প্রকাশ করেছেন, না আনন্দ উল্লাস ও খাওয়া দাওয়া, ফুরতি করার এর মাধ্যমে? সুতরাং নবী (সা) এর সুন্নাত হলো প্রতি সোমবারে রোযা রাখা, যদি তর্কের খাতিরে বলতে হয়, তবে এটাই হলো তাঁর জন্ম দিবস উদযাপন। এটাই হল তাঁর তরীকা। তিনি বলেনঃ من رغب عن سنتي فليس مني “যে আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার মধ্যে নয়।” (বুখারী) অতএব তথাকথিত মিলাদুন্নাবী উদযাপনকারীরা কার অনুসারী এবং কার ধর্মে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অপব্যাখ্যাকারীদের ভ্রান্ত সংশয়ে আর ভ্রুক্ষেপ না করে এখন কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্তে যাই।
     কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্তঃ ইসলাম আল্লাহ তাআলার মনোনীত প্রকটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং এ পূর্ণতার রূপ দান করেছেন এবং তা মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী রাসূল মুহাম্মদ (সা) কে প্রেরণ করেছেন- সাথে সাথে মানবজাতিকে রাসূলে মাধ্যমে সঠিক দিক নির্দেশনাও করেছেন।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক দিন অনুসারে আমল করার তাওফীক দান করুন আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন