সোমবার, ১৮ মে, ২০১৫

হযরত ফাতেমা (রা.) এর কবর কে লক্ষ্য করে হযরত আবূ যর গেফারী (রা.) যা বলেছেন..

ভিত্তিহীন ঘটনার কবলে জীবনের শেষ মুহূর্তও...
হযরত ফাতেমা (রা.) এর কবর কে লক্ষ্য করে হযরত আবূ যর গেফারী (রা.) যা বলেছেন..
░▒▓█►প্রশ্ন : আমি বিভিন্ন বক্তাদের মুখে শুনেছি যে, হযরত ফাতেমা (রা.) কে দাফন করার সময় হযরত আবু যর গিফারী (রা.) তার কবরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, হে কবর! তুমি কি জানো, তোমার মাঝে কাকে রাখা হচ্ছে? তোমার মাঝে যাকে রাখা হচ্ছে, তিনি হলেন প্রিয় নবী (সা.) এর কন্যা, হযরত আলী (রা.) এর স্ত্রী ও হাসান হোসাইন (রা.) এর মাতা। এ কথা বলার সাথে সাথে কবর থেকে আওয়াজ এল, আমি কাউকে চিনি না। আমি প্রত্যেকের আমল অনুযায়ী আচরণ করি!!
এ ঘটনাটি কতটুকু সঠিক? জানিয়ে বাধিত করবেন।


░▒▓█►জবাব : উক্ত ঘটনাটি সত্য নয় বরং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ঘটনা। আর এটি লোকমুখে প্রচলিত বানানো ঘটনা। হাদীস, আছার ও নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থে এ ঘটনা পাওয়া যায় না।
সুতরাং দলিল-প্রমাণহীন এ কথাগুলো বর্ণনা করা জায়েয হবে না। এ থেকে বিরত থাকা জরুরি।

প্রকাশ থাকে যে, আখেরাতের হিসাব-কিতাবের বিষয়টি যে ঈমান ও আমলের ভিত্তিতেই হবে তা দ্বীনের একটি সর্বজনবিদিত শিক্ষা, যা মুসলমান মাত্রই জানা আছে। একজন্য সাহাবায়ে কেরাম কবরকে সম্বোধন করে উপরোক্ত কথা বলতে পারেন এই কল্পনাও মূর্খতা। 
হাদীস শরীফের মাঝে এসেছে-
سنن الترمذي ت شاكر (5/ 338)
3185 - حَدَّثَنَا عَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ قَالَ: حَدَّثَنَا زَكَرِيَّا بْنُ عَدِيٍّ قَالَ: حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرٍو الرَّقِّيُّ، عَنْ عَبْدِ المَلِكِ بْنِ عُمَيْرٍ، عَنْ مُوسَى بْنِ طَلْحَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: لَمَّا نَزَلَتْ {وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ} [الشعراء: 214] جَمَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُرَيْشًا فَخَصَّ وَعَمَّ فَقَالَ: «يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، يَا مَعْشَرَ بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، يَا مَعْشَرَ بَنِي قُصَيٍّ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، يَا مَعْشَرَ بَنِي عَبْدِ المُطَّلِبِ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِي نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكِ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، إِنَّ لَكِ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا»
❏ অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। যখন সূরা আশ শো’আরা এর ২১৪ নং আয়াত {وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ} [الشعراء: 214] অর্থাৎ আপনি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক করে দিন। অবতরণ হলো ........... তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাঁর জীবদ্দশায়ই) নিজ প্রিয়তম কন্যা ফাতেমা (রা.) কে বলে গেছেন-يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِي نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكِ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا، হে ফাতেমা! জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কেননা আমি উপকার-অপকারের মালিক নই। সহীহ বুখারী-৬/১১১, হাদীস-৪৭৭১, সহীহ মুসলিম ১/১৯২, হাদীস-২০৪, জামে তিরমিযী-৫/৩৩৮, হাদীস : ৩১৮৫ ইত্যাদি অসংখ্য কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ রয়েছে।

✿ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই সুস্পষ্ট শিক্ষার পর সাহাবীগণ কবরকে লক্ষ্য করে উপরোক্ত কথাগুলো কীভাবে বলতে পারেন? এ দ্বারা কি সাহাবায়ে কেরামকে মুর্খতার নামান্তর  করা নয়?
আর তা ছাড়াও উক্ত কথাগুলো বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ যর আল গেফারী (রা.) এর শানে? অথচ রাসূল (সা.) তার  সততা সম্পর্কে যা বলেছেন, উক্ত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।

░▒▓█►দেখুন হযরত আবূ যর আল গেফারী (রা.) এর সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর মন্তব্য◄█▓▒

✏ ০১. হযরত আবূ দারদা (রা.) এর হাদীস-
الطبقات الكبرى لابن سعد (4/ 172)
قَالَ: أَخْبَرَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ حَرْبٍ وَالْحَسَنُ بْنُ مُوسَى قَالا: حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ عَنْ عَلِيِّ بْنِ زَيْدٍ عَنْ بِلالِ بْنِ أَبِي الدَّرْدَاءِ عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ : قَالَ رسول الله  : مَا أَظَلَّتِ الْخَضْرَاءُ وَلا أَقَلَّتِ الْغَبْرَاءُ مِنْ ذي لهجة أصدق من أبي ذر .
অর্থ : হযরত আবূ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) বলেছেন, আকাশের নিচে ও যমীনের উপর বিচরণ কারীদের মধ্যে আবূ যরের ন্যায় সত্যবাদী খুবই স্বল্প রয়েছে। আত তাবাকাতুল কোবরা লি ইবনে সাদ-৪/১৭২, মুসতাদরাক-৩/৩৮৭, হাদীস-৫৪৬৭, মুসনাদে আহমাদ-৪৫/৪৮৫, হাদীস-২৭৪৯৩ ইত্যাদি কয়েক ডজন কিতাবে হাদীসটি আছে।

❀❖হাদীসটির মান : 
হাদীসটি হাসান, হাদীস এর সনদ এর মাঝে সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য কিন্তু ‘‘আলি ইবনে যায়দ(১৩১জন্ম)’’কে নিয়ে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। কিন্তু জরাহ ও তাদীলের অসংখ্য ইমাম তাকে সেকাত তথা নির্ভরযোগ্য ও সুদুক তথা সত্যবাদী বলে মন্তব্য করেছেন। যেমন ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন-صدوق আর হাফেজ যাহাবী (রহ.) বলেন-أحد الحفاظ وليس بالثبت ইমাম ইয়াকুব ইবনে শায়বা আদদাওসী (রহ.) বলেন-ثقة صالح الحديث ইমাম যাকারীয়া ইবনে ইয়াহয়া আছছাজী বলেন-من أهل الصدق তাই উক্ত ইমামদের মতামত অনুসারে ‘‘আলি ইবনে যায়দ’’ এর মত বর্ণনাকারী থাকলে হাদীসটি হাসান হতে কোন বাধা নেই আর হাফেজ যাহাবী (রহ.) বলেন-المستدرك على الصحيحين للحاكم (3/ 387)
[التعليق - من تلخيص الذهبي] 5467 - سنده جيد হাদীসটির সনদ উত্তম ও ইমাম ইবনে জারীর আত তাবারী (রহ.) উক্ত হাদীসটি কে সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। দেখুন তাহযীবুল আসার মুসনাদে আলী ইবনে আবী তালেব-১৫৮।

✏ ০২. হযরত আবূ বুরাইদা (রা.) তার পিতা থেকে বর্ণনা কৃত হাদীস-
سنن الترمذي ت شاكر (5/ 636)
3718 - حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ مُوسَى الفَزَارِيُّ ابْنُ بِنْتِ السُّدِّيِّ قَالَ: حَدَّثَنَا شَرِيكٌ، عَنْ أَبِي رَبِيعَةَ، عَنْ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ اللَّهَ أَمَرَنِي بِحُبِّ أَرْبَعَةٍ، وَأَخْبَرَنِي أَنَّهُ يُحِبُّهُمْ». قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ سَمِّهِمْ لَنَا، قَالَ: «عَلِيٌّ مِنْهُمْ»، يَقُولُ ذَلِكَ ثَلَاثًا «وَأَبُو ذَرٍّ، وَالمِقْدَادُ، وَسَلْمَانُ أَمَرَنِي بِحُبِّهِمْ، وَأَخْبَرَنِي أَنَّهُ يُحِبُّهُمْ»
অর্থ : রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে চারজন ব্যক্তিকে ভালোবাসতে বলেছেন এবং তারাও আমাকে ভালোবাসে, জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে তাদের নাম বলে দিন। রাসূল (সা.) বললেন, আলী (রা.) তাদের একজন আর বাকি তিনজন হলো হযরত আবূ যর আল গেফারী, হযরত মিকদাদ (রা.) ও সালমান ফারেসী (রা.)। আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসতে বলেছেন এবং তারাও আমাকে ভালোবাসে। তিরমীযি-৫/৬৩৬, হাদীস-৩৭১৮, ইবনে মাজা-১/৫৩, হাদীস-১৪৯, ‍মুসতাদরাক-৩/১৪১, হাদীস-৪৬৪৯ ইত্যাদি অসংখ্য কিতাবে হাদীসটি রয়েছে। 

❀❖হাদীসটির মান : 
উক্ত হাদীসটি যয়ীফ কিন্তু ফাযায়েলের ক্ষেত্রে আমল যোগ্য। হাফেয যাহাবী (রহ.) বলেন উক্ত সনদে ‘‘আবী রাবিয়া’’ না থাকলে ইমাম মুসলিম (রহ.) ও হাদীসটি গ্রহণ করতেন। এছাড়াও ইমাম ইবনু মুঈন তাকে সিকাহ বা নির্ভরযোগ বলেছেন, ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) মাকবুল বা গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন আর ইমাম আবূ হাতেম রাজি (রহ.) তার সম্পর্কে নিন্দিত মন্তব্য করেছেন।

✏ ০৩. হযরত আলী (রা.) এর হাদীস-
سنن الترمذي ت شاكر (5/ 662)
3785 - حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عُمَرَ قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ كَثِيرٍ النَّوَّاءِ، عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ، عَنْ المُسَيِّبِ بْنِ نَجَبَةَ، قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ كُلَّ نَبِيٍّ أُعْطِيَ سَبْعَةَ نُجَبَاءَ رُفَقَاءَ أَوْ رُقَبَاءَ وَأُعْطِيتُ أَنَا أَرْبَعَةَ عَشَرَ»، قُلْنَا: مَنْ هُمْ؟ قَالَ، «أَنَا وَابْنَايَ، وَجَعْفَرُ، وَحَمْزَةُ، وَأَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ، وَمُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ، وَبِلَالٌ، وَسَلْمَانُ، وَعَمَّارٌ، وَالْمِقْدَادُ، وَحُذَيْفَةُ، وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْعُودٍ»
অর্থ : হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে সাত জন মহৎ ব্যক্তি, বন্ধু, তত্ত্বাবধানকারী দিয়েছেন আর আমাকে দিয়েছেন চৌদ্দজন........তার মধ্যে একজন হলো হযরত আবূ যার গেফারী (রা.) । তিরমিযী-৫/৬৬২, হাদীস-৩৭৮৫, ফায়েলুস সাহাবা লি আহমদ-১/১৩৬, হাদীস-১০৯, মুসনাদে আহমদ-২/৩৮৩, হাদীস-১২০৬, মুসতাদরাক-৩/২২০, হাদীস-৪৯০১ ইত্যাদি অসংখ্য কিতাব এর মাঝে উল্লেখ রয়েছে।

❀❖হাদীসটির মান : 
হাদীসটি যয়ীফ (ফাযায়েলের ক্ষেত্রে আমল যোগ্য) কেননা তার সনদ এর মাঝে ‘কাসিরুন নাওয়া’ একজন দূর্বল বর্ণনাকারী যদি ইমাম আবূ হাতেম আল বুসতী তকে নির্ভেরযোগ্য বর্ণনাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইমাম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল ইজলী বলেন, তার মাঝে কোন সমস্যা নেই।

অতএব মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এত বড় একজন ফযীলত সম্বলীত সাহাবী, হযরত আবূ যর গেফারী (রা.) এর বরাত দিয়ে এধরনের ভিত্তিহীন ঘটনা বর্ণনা করা থেকে হেফাযত করুন। আমীন।

✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন