রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫

০১ম পর্ব : তাবলীগ বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে এখন এতেকাফ নিয়েও বিভ্রান্তিতে সালাফীগণ

০১ম পর্ব
তাবলীগ বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে এখন এতেকাফ নিয়েও বিভ্রান্তিতে সালাফীগণ

❖ প্রশ্ন : কথিত আহলে হাদীস তথা সালাফী ভাইয়েরা বলেন, তাবলীগের সাথীগণ (রমজান ব্যতীত) এতেকাফের নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান করেন, অথচ ইসলামে ইতেকাফ বলতে মাহে রমজানের শেষ দশ দিন ছাড়া আর কোথাও নেই। তাহলে তারা কিসের এতেকাফ করে? তাদের এই তথ্য কি সঠিক? জানিয়ে বাধিত করবেন।


❖ জবাব  : তাদের এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল ও মুসলিমদেরকে প্রকৃত দ্বীনের মেহনত থেকে সরিয়ে দিতে এই ষড়যন্ত্রের পন্থা অবলম্বন করেছে। আমরা তাদেরকে লক্ষ করে বলতে চাই ‘‘যতই তোমরা ফেৎনা কর, নিত্য নতুন ফন্দি আঁক লাভ হবে না।’’ কেননা কোরআন ও সুন্নাহের দৃষ্টিতে দেখলে এতেকাফ তিন প্রকার। তা সাব্যস্ত হয়। যা নিন্মে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

✏ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামি (রহ.) বলেন-
الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (2/ 441)
(وَهُوَ) ثَلَاثَةُ أَقْسَامٍ (وَاجِبُ النَّذْرِ) بِلِسَانِهِ وَبِالشُّرُوعِ وَبِالتَّعْلِيقِ ذَكَرَهُ ابْنُ الْكَمَالِ (وَسُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ فِي الْعَشْرِ الْأَخِيرِ مِنْ رَمَضَانَ) أَيْ سُنَّةُ كِفَايَةٍ كَمَا فِي الْبُرْهَانِ وَغَيْرِهِ لِاقْتِرَانِهَا بِعَدَمِ الْإِنْكَارِ عَلَى مَنْ لَمْ يَفْعَلْهُ مِنْ الصَّحَابَةِ (مُسْتَحَبٌّ فِي غَيْرِهِ مِنْ الْأَزْمِنَةِ) هُوَ بِمَعْنَى غَيْرِ الْمُؤَكَّدَةِ.
অর্থ : এতেকাফ তিন প্রকার (১) ওয়াজিব যা মানত করার দ্বারা আবশ্যক হয়ে থাকে.....। (২) সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া, যা মাহে রমজানের শেষ দশ দিনে থাকা হয়। (কেফায়া এজন্য বলা হয়েছে যে, মহল্লার মাঝে সবাই থাকতে হয় বরং একজন থাকলেই সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। (৩) উল্লেখিত দুই প্রকার ব্যতীত অন্য যে কোন সময় এতেকাফ করা মুস্তাহাব/নফল। আদ দুররুল মুখতার ও হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন-২/৪৪১।

✏ ০১. ওয়াজিব এতেকাফ এর দলীল-
صحيح البخاري (3/ 48)
2032 - حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ، أَخْبَرَنِي نَافِعٌ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنَّ عُمَرَ سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: كُنْتُ نَذَرْتُ فِي الجَاهِلِيَّةِ أَنْ أَعْتَكِفَ لَيْلَةً فِي المَسْجِدِ الحَرَامِ، قَالَ: «فَأَوْفِ بِنَذْرِكَ»
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় তার পিতা হযরত ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলো যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি জাহেলী যুগে মানত করেছি যে, আমি মাসজিদে হারামে  এতেকাফ করবো, (এখন আমাকে কি এতেকাফ করতে হবে?) রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার মানতকে পুরা কর। বুখারী-৩/৪৮, হাদীস-২০৩২।

❐ অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
صحيح البخاري (8/ 142)
6696 - حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا مَالِكٌ، عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ المَلِكِ، عَنِ القَاسِمِ، عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللَّهَ فَلْيُطِعْهُ، وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ»
অর্থ : হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ যদি আল্লাহর আনুগত্যের মানত করে, তাহলে সে যেন অবশ্যই তা পুরা করে, আর কেউ যদি গুনাহের মানত করে, তাহলে সে যেন ঐ গুনাহ না করে। বুখারী-৮/১৪২, হাদীস-৬৬৯৬।
উল্লেখিত দুটি হাদীস দ্বারা মানত করলে এতেকাফ করা ওয়াজিব তা প্রমাণিত।

✏ ০২. সুন্নাত এতেকাফ এর দলীল-
صحيح البخاري (3/ 47)
2025 - حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ: حَدَّثَنِي ابْنُ وَهْبٍ، عَنْ يُونُسَ، أَنَّ نَافِعًا، أَخْبَرَهُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ»
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সা.) মাহে রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন। (অন্য হাদীসে এসেছে আর সুন্নাত হলো মাহে রমজানের শেষ দশ দিন এতকাফ করা)। বুখারী-৩/৪৭, হাদীস-২০২৫।

✏ ০৩. নফল এতেকাফ এর  দলীল-
{وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ } [البقرة: 125]
অর্থ : আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, এতেকাফ (অবস্থানকারী) ও রুকু সেজদাকারীদের জন্যে পবিত্র রাখ। সূরা আল বাক্বারা-১২৫।
{كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ} [آل عمران: 37]
যখনই যাকারিয়া (মসজিদের) মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন। জিজ্ঞেস করতেন ‘মারইম’ ! এসব খাবার তোমার কাছে কোথা থেকে এলো? তিনি বলতেন, এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন। সূরা আল ইমরান-৩৭।
{ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ} [البقرة: 187]
অর্থ : আর যতক্ষন তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। সূরা বাকারা-১৮৭।

❁ প্রমাণ্যতা : উক্ত তিনটি আয়াতের মাঝে মহান আল্লাহ কোন এতেকাফের কথা নির্ধারণ করেন বলেন নি, তাইতো মুজতাহেদ ও মুহাদ্দেসগণ বলেন মানত ও মাহে রমজান ব্যতীত অন্য সময় এতেকাফ করা মুস্তাহাব বা নফল। যা মুসল্লি ও তাবলীগের সাথীগণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর হযরত মারয়াম (আ.) এর আয়তটিও উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি মসজিদের মেহরাবের মাঝে এতেকাফ ছিলেন যা প্রসিদ্ধ বিষয়।

✏ হাদীস এর মাঝে রাসূল (সা.) বলেন-
الجامع الصغير وزيادته (ص: 12230)
12230 - مَنِ اعْتَكَفَ إِيمَاناً وَاحْتِساباً غُفِرَ لَهُ مَا تقدم من ذنبه
(فر) عن عائشة.
অথ : যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত সাওয়াবের আশায় এতেকাফ করে আল্লাহ তার পূববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। আল জামেউস সগীর-১২২৩০। 
প্রমাণ্যতা : এধরনের আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে যেখানে মাহে রমজান বা মান্নত এর এতেকাফের কথা উল্লেখ নেই তাহলে নিশ্চয় বুঝা গেলো এটি ত্বিতীয় প্রকারের এতেকাফ তথা নফলসহ সব প্রকারের সাওয়াবের প্রতি অর্পন করা হবে।

✏ আহলে হাদীসদের মহাগুরু শায়খ নাসীর উদ্দীন আলবানী বলেন-
إرواء الغليل في تخريج أحاديث منار السبيل (4/ 139)
وزاد البيهقى: " ........... , ولا اعتكاف إلا فى مسجد جماعة , والسنة فيمن اعتكف أن يصوم ".
قلت: وإسناده صحيح.
❑ ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, এতেকাফ অবশ্যই এমন মসজিদে হতে হবে। যাতে জামাত অনুষ্ঠিত হয়, আর এতেকাফ অবস্থায় রোজা রাখা সুন্নাত। লিখক (শায়খ আলবানী বলেন) হাদীসটি সহীহ।
❖ প্রমাণ্যতা : দেখুন আহলে হাদীস ভাইগণ বলেন, মাহে রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করা ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের এতেকাফ করার প্রমাণ নেই। এখন আমার কথা হলো আলবানী সাহেব উক্ত আলোচনায় বলেছেন ‘‘এতেকাফ অবস্থায় রোজা রাখা সুন্নাত’’ তাহলে কি তাদের নিকেটে মাহে রমজানের রোজা রাখা সুন্নাত? না কি ফরজ? যদি বলেন সুন্নাত তাহলে আপনি কোরআন বিরোধী। কেননা আল্লাহ কোরআনে বলেন-{كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ } [البقرة: 183] তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে বলতে হবে ফরজ।
এখন আসুন তাহলে উক্ত হাদীসে ‘‘এতেকাফ অবশ্যই এমন মসজিদে হতে হবে যাতে জামাত অনুষ্ঠিত হয়, আর এতেকাফ অবস্থায় রোজা রাখা সুন্নাত।’’ দ্বারা বুঝা গেলো এতেকাফ যে কোন সময় হতে পারে চাই তা একদিনের জন্য হোক অথবা তার চেয়ে কম সময়ের জন্য। উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেলো শায়খ আলবানী নিজেই এতেকাফ তিন প্রকারের প্রবক্তা ছিলেন। তাহলে এখন থেকে যেন আহলে হাদীস ভাইগণ নিজ মন্তব্য ও মতামত পরিবর্তন করে সঠিক আকিদা গ্রহণ করে। ইরওয়াউল গালীল লিল আলবানী-৪/১৩৯। 

❑ উল্লেখ্য যে মুজতাদের, ফুকাহা ও মুহাদ্দীসগণ, সহীহ বুখারীর প্রথম হাদীস ‘‘ সব আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল’’ এর অনুসারে বলেন  এতেকাফের মাঝে নিয়ত আবশ্যক।

░▒▓█►উক্ত মতবাদের ভাইদের প্রতি প্রশ্ন : 
আপনারা বলেন, এতেকাফ মাত্র এক প্রকার তা হলো মাহে রমজানের শেষ দশ দিন । এখন আসুন আপনারা নিন্ম হাদীসে বর্ণিত  এতেকাফ কে কি নামে নাম করণ করবেন?
صحيح ابن حبان - محققا (8/ 423)
3664 - أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ السَّامِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي عَدِيٍّ، عَنْ حُمَيْدٍ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ مُقِيمًا يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، فَإِذَا سَافَرَ اعْتَكَفَ مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلِ عِشْرِينَ (1) .
__________
(1) إسناده صحيح
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূল (সা.) মুকিম অবস্থায় মাহে রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন, আর যদি মুসাফির অবস্থায় থাকেন তাহলে পরবর্তী রমজানে বিশ দিন এতেকাফ করতেন। ইবনে হিব্বান-৮/৪২৩, হাদীস-৩৬৬৪। 
শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী উক্ত হাদীসকে সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। সিলসিলাতুস সহীহা-৩/৩৯৯, হাদীস-১৪১০। আল্লামা সাফরীনী আল হাম্বলী বলেন হাদীসটি হাসান। শারহু সোলাসিয়াতুল মুসনাদ-১/৬৩২। সব অবস্থায় হাদীসটি প্রমাণযোগ্য। 
✏ এখন সালাফী ভাইদের প্রতি প্রশ্ন হলো ‘‘পরবর্তী রমজানে বিশ দিন এতেকাফ করতেন।’’ এটি কোন তরীকার এতেকাফ? জানিয়ে বাধিত করবেন। কেয়ামত পর্যন্ত সময় দেয়া হলো।
চলবেই ইনশাআল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন