রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

দু’ ঈদের তাকবীরসমূহ নিয়ে মতানৈক্যর সমাধান

দু’ ঈদের তাকবীরসমূহ নিয়ে মতানৈক্যর সমাধান
          ❖ প্রশ্ন :  দু’ ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি কিংবা বারটি? যদি উভয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে রাবীগণের সংখ্যাধিক্য কোন দিকে প্রমাণ করে? আর এ সকল তাকবীর প্রথম রাকআতে ফাতিহা এবং সূরা পড়ার পূর্বে না পরে? অনুরূপ দ্বিতীয় রাকআতে সূরা পড়ার পরে না পূর্বে?
         ❖ জবাব :  এখানেও কতক বিষয় আলোচনাযোগ্য।

          প্রথম : ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এবং ইমাম আহমদ (রহ.) এর মতে দু’ ঈদের নামাযে বার তাকবীর। প্রথম রাকআতে সাতটি এবং দ্বিতীয় রাকআতে পাঁচটি। আর উভয় রাকআতে কিরাআতের পূর্বে হবে। তবে ইমাম মালেক (রহ.) এর মতে প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমাসহ সাতটি তাকবীর। আর অন্যান্যদের মতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত সাত তাকবীর। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.), সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) এবং সাহেবায়ন তথা আবূ ইউসূফ এবং মুহাম্মদ (রহ.) এর মতে উভয় রাকআতে তিন তিন মোট ছয়টি তাকবীর অতিরিক্ত হবে। প্রথম রাকআতে কিরাআতের পূর্বে এবং দ্বিতীয় রাকআতে কিরাতের পরে হবে।


          দ্বিতীয় : বার তাকবীর সম্বন্ধে হাদীছসমূহ বিভিন্ন সাহাবায়ে কিরাম (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। কিন্তু মুহাদ্দিছীন (রহ.) এর অভিমত এই যে, এ মাসয়ালা রাসূল (সা.) থেকে কোন রিওয়ায়তই বিশুদ্ধতার সঙ্গে প্রমাণিত হয়নি। 
ইমাম তিরমিযী (রহ.) বার তাকবীর সম্বন্ধে হাদীছ এ সনদে রিওয়ায়ত করেন যে, কাছীর বিন আবদিল্লাহ বিন আমর বিন আওফ (রহ.), তিনি স্বীয় পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে রিওয়ায়ত করেন যে,

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَبَّرَ فِي العِيدَيْنِ فِي الأُولَى سَبْعًا قَبْلَ القِرَاءَةِ، وَفِي الآخِرَةِ خَمْسًا قَبْلَ القِرَاءَةِ
         
 ❏ অর্থাৎ ‘‘নবী করীম (সা.) দু’ ঈদের প্রথম রাকআতে কিরাআতের পূর্বে সাত তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে কিরাআতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর বলেছেন।

❏ ইমাম তিরমিযী (রহ.) উপরোক্ত রিওয়ায়ত নকল করে লিখেছেন :
حَدِيثٌ حَسَنٌ، وَهُوَ أَحْسَنُ شَيْءٍ رُوِيَ فِي هَذَا البَابِ* (ترمذى شريف ص : ৭০ ج : ১)
          
অথাৎ ‘‘এ হাদীছ হাসান। আর এ বিষয়ে যতগুলো হাদীছ বর্ণিত আছে সেগুলোর মধ্যে ইহা সর্বাপেক্ষা উত্তম।’’

          উক্ত হাদীছখানা, যা ইমাম তিরমিযী (রহ.) এর মতে এ বিষয়ে বর্ণিত রিওয়ায়তসমূহের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম। ইহা কাছীর বিন আবদিল্লাহ (রহ.) এর উপর নির্ভরশীল। আর তার রিওয়ায়ত সম্বন্ধে মুহাদ্দিছীন (রহ.) এর মতামত হচ্ছে এই যে,
          ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, لايساوى شيئا (ইহা কোন জিনিসের বরাবর নয়)। ইবনে মুঈন (রহ.) বলেন, حديث ليس بشئ (তার বর্ণিত হাদীছ কোন বস্তুই নয়)। ইমাম নাসায়ী (রহ.) এবং দারা কুতনী (রহ.) বলেন , متروك الحديث (বর্জিত হাদীছ)। ইমাম আবূ যুরআ (রহ.) বলেন, واه الحديث (দুঃখজনক হাদীছ)। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, ركن من اركان الكذب (মিথ্যার স্তম্ভমূহের মধ্যে একটি স্তম্ভ)। ইমাম ইবনে হেব্বান (রহ.) বলেন,
 روى عن ابيه عن جده نسخة موضوعة لايحل ذكرها فى الكتاب الا على سبيل التعجب* (نصب الراية ص : ২১৭ ج : ২)
অর্থাৎ তিনি নিজ বাপ-দাদার সনদে একটি বানাউট এবং মনগড়া কথা রিওয়ায়ত করেছেন, যা কিতাবে উল্লেখ করাও জায়েয নয়। তবে হ্যাঁ, আশ্চর্য প্রকাশ স্থলে উল্লেখ করা যেতে পারে।)’’
          
      উপরোক্ত রিওয়াত, যার সম্বন্ধে أَحْسَنُ شَيْءٍ فِي هَذَا البَابِ (এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা উত্তম হাদীছ) বলা হয়েছে। এর অবস্থা যখন এরূপ তাহলে এ অনুচ্ছেদের সংকলিত অন্যান্য রিওয়ায়ত সমূহের অবস্থা যে কি হবে? তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম তিরমিযী (রহ.) এর হাদীছ সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন মুহাদ্দিছীন (রহ.) তার সঙ্গে একমত নহেন। সম্ভবত: এ রিওয়ায়ত থেকে আব্দুল্লাহ বিন আবদির রহমান আল তায়িফী (রহ.) এর রিওয়ায়ত ভাল। (عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده) যেমন ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) রেওয়ায়ত করেছেন (১ম খ- ১৬৩ পৃ.)। যদিও এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে সমালোচনা আছে।

          তৃতীয় : উভয় রাকআতের মধ্যে তিন তাকবীর সম্বন্ধে বর্ণিত হাদীছসমূহ যদিও সংখ্যায় খুবই অল্প। কিন্তু সম্ভবত: শক্তি, নির্ভরযোগ্যতা এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর কৃত আমলের দিক দিয়ে প্রথমে উল্লেখিত রিওয়াত থেকে উৎকৃষ্ট। কেননা,

     ১। ইমাম তাহাভী (রহ.) আবূ আবদির রহমান কাসিম (রহ.) এর রিওয়ায়ত নকল করেন :

حَدَّثَنِي بَعْضُ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: صَلَّى بِنَا , النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عِيدٍ , فَكَبَّرَ أَرْبَعًا , وَأَرْبَعًا , ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ حِينَ انْصَرَفَ , قَالَ: ্রلَا تَنْسَوْا , كَتَكْبِيرِ الْجَنَائِزِ , وَأَشَارَ بِأَصَابِعِهِ , وَقَبَضَ إِبْهَامَهُ (ص : ৪০০ ج : ৩)

❏ অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর কতক সাহাবী (রা.) আমার নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) আমাদেরকে নিয়ে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। তখন তিনি চার চার তাকবীর বলেছেন, নামায শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ইরশাদ করলেন, ভুলে যেয়েও না, ঈদের তাকবীরসমূহ জানাযার ন্যায় পাঁচটি। আর হাতের আঙ্গুলগুলো দ্বারা ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু মুবারক বৃদ্ধাঙ্গুলি বন্ধ করে রেখেছেন।’’
          ইমমা তাহাভী (রহ.) এ হাদীছ রিওয়ায়ত করার পর লিখেন :
فَهَذَا حَدِيثٌ , حَسَنُ الْإِسْنَادِ. وَعَبْدُ اللهِ بْنُ يُوسُفَ , وَيَحْيَى بْنُ حَمْزَةَ , وَالْوَضِينُ وَالْقَاسِمُ كُلُّهُمْ أَهْلُ رِوَايَةٍ , مَعْرُوفُونَ بِصِحَّةِ الرِّوَايَةِ*
  
অথাৎ উক্ত হাদীছের সনদ হাসান। এর সকল রাবী তথা আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ, ইয়াহইয়া বিন হামযাহ, ওযীন বিন আতা এবং কাসিম (রহ.) সকলেই আহলে রিওয়ায়ত। সহীহ রিওয়ায়ত সম্পর্কে তারা অবহিত।’’
          উক্ত হাদীছের সকল রাবী প্রসিদ্ধ। তবে ওযীন বিন আতা (রহ.) কে কেউ কেউ দুর্বল বলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের মতে তিনি নির্ভরযোগ্য। হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) ফাতহুল বারী গ্রন্থের ২য় খণ্ডে ৪০১ পৃষ্ঠায় মাসয়ালায়ে বিতর সম্বন্ধে তার একটি রিওয়ায়তকে اسناده قوى (শক্তিশালী সনদ) বলে আখ্যা দিয়েছেন। কাজেই তার সনদ ‘হাসান’ হবে যেমন ইমাম তহাভী (রহ.) বলেছেন :

عن عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ ثَابِتِ بْنِ ثَوْبَانَ عَنْ أَبِيهِ أَنَّهُ سَمِعَ مَكْحُولًا يَقُولُ: حَدَّثَنِي أَبُو عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ سَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ دَعَا أَبَا مُوسَى الْأَشْعَرِيَّ وَحُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا , فَسَأَلَهُمَا كَيْفَ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُكَبِّرُ فِي الْأَضْحَى وَالْفِطْرِ؟ فَقَالَ أَبُو مُوسَى: أَرْبَعًا , كَتَكْبِيرِهِ عَلَى الْجَنَائِزِ , وَصَدَّقَهُ حُذَيْفَةُ. فَقَالَ أَبُو مُوسَى: كَذَلِكَ كُنْتُ أُكَبِّرُ لِأَهْلِ الْبَصْرَةِ , إِذْ كُنْتُ أَمِيرًا عَلَيْهِمْ " قال ابو عائشة وانا حاضر سعيد بن العاص* (ابو داؤد ص : ১৬৩ ج : ১، طحاوى ص : ৪০০ ج : ২، مسند احمد ص : ৪১৬ ج : ৪)

❏ অর্থাৎ হযরত আব্দুর রহমান বিন ছাবিত বিন ছাওবান (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা ছাবিত বিন ছাওবান (রহ.) থেকে, তিনি মাকহুল (রহ.) থেকে, তিনি বলেন যে, হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর বন্ধু আবূ আয়িশা আমাকে বলেছেন যে, হযরত সাঈদ বিন আস (রা.) হযরত আবূ মূসা আশআরী এবং হযরত হুযায়ফা বিন ইয়ামান (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, রাসুল (সা.) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর এর নামাযে কতবার তাকবীর বলতেন? হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.) জবাবে বললেন, তিনি চার চার তাকবীর বলতেন যেমনভাবে জানাযার নামাযে তাকবীর বলতেন। হযরত হুযায়ফা (রা.) তা সত্যায়িত করে বললেন, তিনি সঠিক বলেছেন। হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.) বলেন যে, আমি যখন বসরার হাকিম তথা বিচারক ছিলাম তখন এভাবেই তাকবীর বলতাম। আবূ আয়িশা বলেন যে, সাঈদ বিন আস (রা.) প্রশ্ন করার সময় আমি স্বয়ং উপস্থিত ছিলাম।’’
          হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) তাকরীব গ্রন্থে আব্দুর রহমান বিন ছাবিত বিন ছাওবান (রহ.) কে صدوق يخطئ يرمى بالقدر এবং আবূ আয়িশাকে مقبول বলেছেন। আর হযরত সাঈদ বিন আস (রা.) এর ঘটনাকে ইমাম তহাভী (রহ.) অন্য এক সূত্রে এই ভাবে নকল করেছেন।

عَنْ مَكْحُولٍ قَالَ: حَدَّثَنِي رَسُولُ حُذَيْفَةَ وَأَبِي مُوسَى رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُكَبِّرُ فِي الْعِيدَيْنِ أَرْبَعًا وَأَرْبَعًا , سِوَى تَكْبِيرَةِ الِافْتِتَاحِ (ص : ৪০০ ج : ২)

❏ অর্থাৎ হযরত মাকহুল (রহ.) বলেন যে, আমাকে হযরত হুযায়ফা এবং হযরত আবূ মুসা আশআরী (রা.) এর দূত বলেছেন যে, রাসূল (সা.) দু’ ঈদে (রুকুর তাকবীরসহ) চার চার তাকবীর বলতেন তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত।’’

          চতুর্থ : প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের ভরসা মরফূ হাদীছসমূহের স্থলে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর কৃত আমলের উপর রয়েছে। যেমন ইবনে রুশদ (রহ.) স্বীয় বিদায়াতুল মুজতাহিদ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ২১৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন। কেননা ইমাম মালেক (রহ.) মুয়াত্তা গ্রন্থের ৬৩ পৃষ্ঠায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর আমল থেকে সাত এবং পাঁচ তাকবীরের রিওয়ায়ত নকল করে বলেন, وهو الامر عندنا (এটাই আমাদের আমল)।

          আর সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর আমলও এ বিষয়ে বিভিন্ন ভাবে রয়েছে। যেমন, হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর আমল মুয়াত্তা গ্রন্থের বরাতে ইতিপূর্বে গেল। আর হযতর আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন মর্মের রিওয়ায়ত বর্ণিত হয়েছে।

          তার থেকে একটি রিওয়ায়ত এই যে, তিনি উভয় রাকআতে কিরাআতের পূর্বে বারটি তাকবীর বলতেন। প্রথম রাকআতে সাত তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে পাঁচ তাকবীর। যেহেতু এ রিওয়ায়তের উপর আব্বাসিয়া খলীফগণ আমল করেছেন সেহেতু ইহা অধিক খ্যাতি লাভ করেছে। আর ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এবং ইমাম আহমদ (রহ.) একেই গ্রহণ করেছেন।

          তার থেকে দ্বিতীয় রিওয়ায়তটি হানাফীগণের আমলের মুতাবিক রয়েছে।
 (তহাভী ৩য় খণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠা, আব্দুর রাযযাক ১ম খণ্ড ২৯৪ পৃ.)

তৃতীয় রিওয়ায়তে আছে যে, তিনি তের তাকবীর বলতেন। প্রথম রাকআতে কিরাআতের পূর্বে সাত তাকবীর এবং দ্বীতিয় রাকআতে কিরাআতের পরে ছয় তাকবীর। (তহাভী ১ম খণ্ড ৪০১ পৃষ্ঠা)
          চতুর্থ রিওয়ায়তে রয়েছে যে, তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি চায় সাত তাকবীর বলবে আর যে চায় নয়, এগার কিংবা তের তাকবীর বলবে।   (তহাভী ১ম খ- ৪০১ পৃ.)
                           
          হানাফীগণের আমল হচ্ছে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) এর হাদীছের উপর। কেননা তার থেকে বিভিন্ন সনদ (সূত্রে) বর্ণিত আছে যে, তাকবীরে তাহরীমার পর তিন তাকবীর বলবে। অতঃপর কিরাআত পড়বে। আর দ্বিতীয় রাকআতে কিরাত পড়ার পর তিন তাকবীর বলবে। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) এর হাদীছসমূহ নসবুর রায়অহ ১ম খণ্ড ২১৩ ও ২১৪ পৃষ্ঠায়, আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ২৯৩ পৃষ্ঠায়, তাহাভী ২য় খণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠায় কিতাবুল হুজ্জতি আলা আহলিল মদীনা ১ম খণ্ডের ৩০৩ পৃষ্ঠায়, কিতাবুল আছার ৫৩৭ পৃষ্ঠায়, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ২য় খণ্ডের ২০৫ পৃষ্ঠায়, তাফসীর ইবনে কাছীর ৩য় খণ্ডের ৫১২ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)।

অনেক সাহাবায়ে কিরাম (রা.) থেকে হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণিত রিওয়ায়তের সত্যায়ন ও অনুরূপ রিওয়ায়ত বর্ণিত আছে। যেমন :

১। ইমাম তাহাভী (রহ.) باب التكبير على الجنازة এর মধ্যে হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী (রহ.) এর রিওয়ায়ত থেকে একটি দীর্ঘ হাদীছ নকল করেছেন যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর মধ্যে জানাযা নামাযের তাকবীরসমূহে মত পার্থক্য ছিল। হযরত উমর (রা.) তাদেরকে এক তরীকার উপর ঐক্যমত হওয়ার পরামর্শ দেন।
فَأَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ عَلَى أَنْ يَجْعَلُوا التَّكْبِيرَ عَلَى الْجَنَائِزِ , مِثْلَ التَّكْبِيرِ فِي الْأَضْحَى وَالْفِطْرِ , أَرْبَعَ تَكْبِيرَاتٍ* (طحاوى ص : ২৩৯ ج : ১)
❏ অর্থাৎ কাজেই তারা সকলে এ বিষয়ে একমত হন যে, জানাযার তাকবীরসমূহ এতগুলো তাকবীর হোক যতগুলো তাকবীর দু’ ঈদের নামাযে রয়েছে অর্থাৎ চার তাকবীর।’’
দু’ ঈদের নামাযের প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমারসহ এবং দ্বীতিয় রাকআতে রুকুর তাকবীরসহ মোট চার তাকবীর হয়। এই রিওয়ায়ত দ্বারা হযরত উমর (রা.) এবং তার পরামর্শদানকারীগণ উভয় ঈদের তাকবীরসমূহের ব্যাপারে সর্বসম্মত বলে প্রমাণিত হয়।

 عَنْ عَامِرٍأَنَّ عُمَرَ وَعَبْدَ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا , اجْتَمَعَ رَأْيُهُمَا فِي تَكْبِيرِ الْعِيدَيْنِ عَلَى تِسْعِ تَكْبِيرَاتٍ , خَمْسٌ فِي الْأُولَى , وَأَرْبَعٌ فِي الْآخِرَةِ , وَيُوَالِي بَيْنَ الْقِرَاءَتَيْنِ.(طحاوى ص : ৪০০ ج : ২)

। অর্থাৎ ‘হযরত আমির শা’বী (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রা.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) এর অভিমত এ বিষয়ে সম্মত হয়েছে যে, দু’ ঈদের নামাযে নয়টি তাকবীর হবে। পাঁচ প্রথম রাকআতে এবং চার দ্বিতীয় রাকআতে হবে এবং উভয় রাকআতে কিরাআতের সঙ্গে সঙ্গে হবে।’’

অর্থাৎ প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমা এবং রুকুর তাকবীরসমূহ পাঁচ তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে রুকুর তাকবীরসমূহ চার তাকবীর। আর কিরাআতের সঙ্গে সঙ্গে হওয়ার মর্ম এই যে, প্রথম রাকআতে কিরাআতের পূর্বে তাকবীরসমূহ বলা হবে এবং দ্বিতীয় রাকআতের কিরাআতের পরে তাকবীরসমূহ বলতে হবে

৩। তহাভী শরীফের ২য় খণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠায়, আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ২৯৩ পৃষ্ঠায়, কিতাবুল হুজ্জাহ, ইমাম মুহাম্মদ ১ম খণ্ডের ৩০৩ পৃষ্ঠায়, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ২য় খণ্ডের ২০৫ পৃষ্ঠায়, তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩য় খণ্ডের ৫১৩ পৃষ্ঠায়, হযরত হুযায়ফা বিন ইয়ামান  এবং হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.), হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) এর ফাতওয়ার সত্যায়িত করার বিষয়টি সহীহ সনদ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে।

৪। আর আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ২৯৪ পৃষ্ঠায় হযরত জাবির (রা.) থেকে উহার অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।
৫। আর আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ২৯৫ পৃষ্ঠায় হযরত মুগীরা বিন শু’বা (রহ.) থেকেও ইহাই বর্ণিত হয়েছে।
৬। ইবনে আবী শায়বা গ্রন্থে হযরত আবূ মাসউদ আনসারী (রা.) থেকেও হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) এর সমর্থন বর্ণিত আছে।
৭। তাহাভী (১ম খেণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠায়) হযরত ইবনে যুবায়র (রা.) এরও এই আমলই নকল করেছেন।
৮। ইমাম তহাভী (১ম খণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠায়) হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকেও ইহাই নকল করেছেন।
৯। এর অনুরূপ হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর আমল ছিল, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

          পঞ্চম : যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হাদীছসমূহ এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর কৃত আমল উভয়ভাবে রয়েছে সেহেতু আমাদের মতে উভয় তরীকাই জায়েয এবং ভাল। কিন্তু প্রত্যেক রাকআতে তিন তিনি তাকবীর বলার তরীকা অতি উত্তম এবং প্রাধান্য। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) মুয়াত্তা গ্রন্থে বলেন :

قَدِ اخْتُلِفَ الناسُ فِي التكبيرِ في العيدين، فما أخذتَ بِهِ فَهُوَ حَسَنٌ وَأَفْضَلُ ذَلِكَ عِنْدَنَا مَا رُوِيَ عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ أَنَّهُ كَانَ يكبِّر في كل عيد تسعاً: خَمْسًا وَأَرْبَعًا ، فيهنَّ تَكْبِيرَةُ الافْتِتَاحِ وَتَكْبِيرَتَا الرُّكُوعِ، ويوالي بين القراءتين، ويؤخِّر ها فِي الأُولَى، ويقدِّمها فِي الثَّانِيَةِ، وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ.*

অর্থাৎ দু’ ঈদের তাকবীর সম্বন্ধে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কাজেই যে কোন তারীকার ভিত্তিতে আমল করলে জায়েয হবে। কিন্তু আমাদের নিকট উত্তম হলো সেই তরীকা যা হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি প্রত্যেক ঈদের নামাযে নয় তাকবীর বলতেন। প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমা এবং রুকুর তাকবীরসহ পাঁচ তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে রুকুর তাকবীরসহ চার তাকবীর। আর উভয় রাকআতের কিরাআত লাগাতার করতেন। প্রথম রাকআতে তাকবীরের পরে কিরাআত পড়তেন এবং দ্বিতীয় রাকআতে তাকবীরের পূর্বে কিরাআত পড়তেন। ইহাই হলো ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এর অভিমত। ’’ (১৪১ পৃষ্ঠা)

          প্রতি রাকআতে তিন তাকবীর অতি উত্তম ও প্রাধান্য হওয়ার দলীলসমূহ নিন্মে প্রদত্ত হলো। 
১। হাদীছ নম্বর (১) এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূল (সা.) চার চার তাকবীর (তাকবীরে রুকুসহ) বলেছেন এবং নামায শেষ করে ইরশাদ করেন, ভুল কর না, ঈদের নামাযে চার চার তাকবীর রয়েছে জানাযার নামাযের ন্যায়। আর তিনি স্বীয় আঙ্গুলগুলো দ্বারা ইঙ্গিত করেন এবং বৃদ্ধঙ্গুলি বন্ধ রাখেন। সুতরাং এই আমল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণী, কর্ম, ইংঙ্গিত, দলীল এবং তায়ীদ দ্বারা প্রমাণিত।
২। পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, তিন তিন তাকবীর সম্পর্কিত হাদীছসমূহ বিশুদ্ধতাও শক্তির দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট।
৩। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) এবং আকাবির সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর ইহার উপরই অধিক আমল ছিল। অথচ ইবনে আব্বাস (রা.) এর আমল বিভিন্নরূপ ছিল। কখনো বার কখনো ছয় তাকবীর বলতেন।
৪। ইহা তো স্পষ্ট যে, শরীআত উভয় ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর সাধারণ নামাযের নিয়মের বিপরীত একটি তরীকা নির্ধারিত হয়েছে। আর ইহাও স্পষ্ট যে, ছয় তাকবীর সম্পর্কে ছাহাবায়ে কিরাম (রা.) সর্বসম্মত রয়েছেন এবং এর চেয়ে বেশীর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সুতরাং দৃঢ় ও সর্বসম্মত বস্তুকে গ্রহণ করা এবং বিরোধপূর্ণ বস্তুকে পরিত্যাগ করাই উত্তম হবে।
والله تعالى اعلم

❐ বি. দ্র. :  সন্মানিত পাঠকগণ আপনারা এই ব্লগ এর প্রতি দৃষ্টি রাখুন, কেননা এ বিষয়ে আরো অনেকগুলো দলীল বা প্রমাণ অচিরেই সংযোজিত হবে। 

✔ মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেকটি বিষয় দলীলসহ আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন


✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন