বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

গ্রামে জুমুআ আদায় নিষেধের দলীল

গ্রামে জুমুআ আদায় নিষেধের দলীল
✿ প্রশ্ন : আমাদের মাযহাব মতে জুমুআর নামাযের শর্তসমূহের একটি শর্ত হলো শহর হওয়া। গ্রামে ও বস্তিতে জুমুআ সহীহ হয় না। কিন্তু এর মুকাবালায় হাদীছসমূহের মাধ্যমে জুমুআ হুকুমকে ব্যাপক প্রমাণিত করা হয় এবং আমাদেরকে জুমুআর ফরযের অস্বীকারকারী বলে গণ্য করা হয়। এ প্রসঙ্গে যে সব হাদীছ পেশ করা হয় তা নিন্মে প্রতত্ত হলো।
আবূ দাউদ শরীফের বরাতে এই শব্দ সমূহে নকল করা হয় যে-
الجمعة حق واجب على كل مسلم فى جماعة*

অর্থাৎ ‘জুমুআ হক, প্রত্যেক মুসলমানের উপর জামাতের সঙ্গে জুমুআর নামায আদায় করা ওয়াজিব।’’
দারা কুতনীর হাদীছে আছে : 
من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فعليه الجمعة يوم الجمعة*

অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও আখিরাতের উপর বিশ্বাস রাখে তার উপর জুমুআর দিন জুমুআর নামায আদায় করা অপরিহার্য।’’


কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারাও ব্যাপক হুকুম প্রমাণ করা হয়। এতদসঙ্গে বলা হয় যে, প্রথম জুমুআ যা, হযরত আসআদ বিন যুরারাহ (রা.) পড়িয়ে ছিলেন তা ‘নকী’ নামক একটি গ্রামেই পড়িয়ে ছিলেন, যা মদীনার নিকটবর্তীতে অবস্থিত। আর সে সময় উক্ত গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা ৪০ জন বলে বর্ণনা করা হয়। বরাতের জন্য ইবনে মাজাহকে পেশ করা হয়। আর ইহাও বলা হয় যে, স্বয়ং মদীনা শরীফ সে যুগে একটি গ্রামই ছিল। এমতাবস্থায় গ্রামে জুমুআর আহকাম কি হবে এবং তাদের হাদীসছসমূহের সঙ্গে সমন্বয় কিভাবে হবে?

জবাব - : এ বিষয়ে কয়েকটি বিসষ লক্ষ্য রাখতে হবে।

১। জুমুআর নামায সবার মতে ফরযে আইন। আল্লামা শাওকানী (রহ.) নায়লুল আওতার’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ২২৪ পৃষ্ঠায় এর উপর চার মাযহাবের ইমামগণ সর্ব সম্মত বলে নকল করেছেন। আর ইবনে হুমাম (রহ.) ‘ফতহুল কদীর’ গ্রন্থে লিখেন : 

واعلم اولا ان الجمعة فريضة محكمة بالكتب والسنة والاجماع يكفر جاحدها*

অর্থাৎ ‘সর্ব প্রথম এ বিষয়টি জেনে নেয়া জরুরী যে, জুমুআর নামায কিতাব, সুন্নত এবং ইজমায়ে উম্মতের আলোকে সুদৃঢ় ফরয। আর এর ফরয হওয়ার বিষয়টি যে অস্বীকার করে সে কাফির।’’

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জুমুআর ফরযকে অস্বীকার করা কুফরী। যদি কিছু লোক হানাফীগণকে জুমুআর ফরযিয়াতের অস্বীকারকারী বলে, যেমন প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলে তাদের এ ছাড়া আর কি বলা যায় যে, তারা তাদের স্বাল্পজ্ঞনের কারণে একটি কবীরা গুনাহ করছে। কেননা কোন মুসলমানকে কুফর এর দিকে সম্বন্ধ করা চরম দুর্ভাগ্য। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে, উক্ত কুফর কথকের দিকে প্রত্যাবর্তন করে আসে। আল্লাহ তায়ালা এ মহামারী থেকে মুসলমানগণকে রক্ষা করুন। 

২। জুমুআর নামায ইমামগণের সর্বসম্মতে যেমন ফরযে আইন, তেমনি এ বিষয়েও সকলেই সম্মত যে, জুমুআর নামায সাধারণ নামাযসমূহের ন্যায় নয়; বরং এর একটি বিশেষ মাহাত্ব্য রয়েছে এবং এর জন্য বিশেষ শর্তসমূহ রয়েছে। প্রথম শর্ত হচ্ছে জামাআত হওয়া, আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে একটি বিশেষ প্রকারের জনবসতি।

এ কারণেই জনমানবহীন জঙ্গলে কারো মতে জুমুআ জায়েয নয়। শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলুভী (রহ.) ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেন : 

وَقد تلقت الْأمة تلقيا معنويا من غير تلقي لفظ أَنه يشْتَرط فِي الْجُمُعَة الْجَمَاعَة وَنَوع من التمدن، وَكَانَ النبى صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. وخلفاؤه رَضِي الله عَنْهُم. وَالْأَئِمَّة المجتهدون رَحِمهم الله تَعَالَى يجمعُونَ فِي الْبلدَانِ، وَلَا يؤاخذون أهل البدو، بل وَلَا يُقَام فِي عَهدهم فِي البدو، ففهموا من ذَلِك قرنا بعد قرن وعصرا بعد عصر أَنه يشْتَرط لَهَا الْجَمَاعَة والتمدن

অর্থাৎ ‘‘আর উম্মত তাওয়াতুরে মা’নুভী (অর্থাৎ যার শব্দ ও আনুষঙ্গিক ব্যাপার বিভিন্ন হলেও মূল মানে বা অর্থটি সকল যুগেই বহু লোক বর্ণনা করেছেন) এর মাধ্যমে যে বস্তু পেয়েছে (যদিও তাওয়াতুর লফযী তথা যার শব্দ একইরূপে সকল যুগে অসংখ্য লোক বর্ণনা করেছেন না হয়) যে, জুমুআর জন্য জামাআত এবং বিশেষ প্রকারের জনবসতি তথা শহর হওয়া শর্ত। 

রসূলুল্লাহ (সা.) তার খলীফাগণ (রা.) এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন (রহ.) সকলেই শহরের মধ্যে জুমুআর নামায প্রতিষ্ঠা করতেন। গ্রামবাসীদেরকে এর মুকাল্লাফ (তথা নির্দেশিত) করতেন না; বরং তাদের যুগে গ্রামে জুমুআ আদায় করা হতো না। সুতরাং উম্মত এ থেকে যুগের পর যুগ বংশের পর বংশ ধরে বুঝে নিয়েছে যে, জুমুআর জন্য জামাআত এবং শহর হওয়া শর্ত।’’

এই বিশেষ প্রকারের শহর হওয়া যা জুমুআ সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত। এর ব্যাখ্যার মতানৈক্য এবং ইজতিহাদের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু শাহ সাহেবের বক্তব্য মতে এই উসূল রসূলুল্লাহ (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) থেকে প্রমাণিত এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন (রহ.) সকলেই সর্বসম্মত যে, জুমুআ প্রত্যেক স্থানে হয় না আর না প্রত্যেক স্থানের লোকদের যিম্মায় ফরয হয়।

৩। এখানে দু’টো মাসয়ালা পৃথক পৃথক রয়েছে। 
এক এই যে, জুমুআ ওয়াজিব হওয়ার জন্য কি কি শর্ত রয়েছে? অর্থাৎ জুমুআ কোন ব্যক্তির উপর ফরয এবং কোন ব্যক্তির উপর ফরয নয়? 
দ্বিতীয় মাসয়ালা এই যে, জুমুআ সহীহ হওয়ার জন্য শর্তসমূহ কি?

উক্ত দু’টো মাসয়ালার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তির উপর জুমুআ ফরয নয় ( যেমন রুগ্ন ব্যক্তি, মুসাফির, গোলাম, এবং মহিলা) যদি তারা জুমুআ আদায় করে, তাহলে তাদের জুমুআ আদায় হয়ে যাবে এবং ওয়াক্তিয়া ফরয (যুহর নামায) তাদের যিম্মা থেকে সাকিত (তথা আদায়) হয়ে যাবে। কিন্তু যদি জুমুআ সহীহ হওয়ার শর্ত না পাওয়া যায়, তাহলে জুমুআ আদায় হবে না; বরং তার দায়িত্ব যুহরের ফরয নামায থেকে যাবে। সে নিজ ধারণা মতে জুমুআ আদায় করা সত্ত্বেও যেন ওয়াক্তিয়া ফরয (যুহর নামায) পরিত্যাগকারী হবে।
 ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইজমায়ে উম্মত দ্বারা বিশেষ প্রকারের শহর হওয়া জুমুআ ওয়াজিব হওয়ার জন্যও শর্ত এবং জুমুআ সহীহ হওয়ার জন্যও। সুতরাং গ্রামবাসীদের উপর সর্বসম্মত মতে জুমুআ ফরযই নয় এবং গ্রামে জুমুআ সর্বসম্মত মতে সহীহও নয়। হযরত শাহ সাহেব মাছওয়া (শরহে মুয়াত্তা) গ্রন্থে লিখেনছেন : 

اتفقوا على ان لا جمعة فى العوالى وانه يشترط لها الجماعة * (ص : ১৫৫ ج : ১)

অর্থাৎ এ বিষয়ে সকলেই একমত যে দরিদ্র পল্লীতে জুমুআ জায়েয নয়। আর এ বিষয়ে যে, জুমুআর জন্য জামাআত শর্ত।’’

৪। হানাফী মাযহাব মতে জুমুআ হয়তো শহরে হবে কিংবা বড় গ্রামে হবে, যার পদমর্যাদা ছোট শহরের হয়। আর শহর এবং কসবা তথা ছোট শহরের আশপাশের সে সব স্থানে যা শহরবাসীদের প্রয়োজন হয় একে فناء مصر (শহরের সংলগ্ন স্থান) বলা হয়। যেহেতু ইহাও শহর এবং ছোট শহরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে সেহেতু এতেও জুমুআ জায়েয আছে। শহর এবং ছোট শহর ব্যতীত ছোট গ্রামে জুমুআ জায়েয নেই।

 ░▒▓█►হানাফীগণের এই মাসয়াাটিও (অন্যান্য মাসায়িলের ন্যায়) কুরআন ও সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর সুন্নতের হুবহু সাদৃশ্যপূর্ণ।◄█▓▒
❖ কুরআন মজীদ : 
সূরায়ে জুমুআয় আল্লাহ শানুহু ইরশাদ করেন : 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ*
অর্থাৎ ‘হে ঈমনদারগণ! জুমুআর দিনে যখন (জুমুআর) নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহ তায়ালার স্মরণের (অর্থাৎ নামায ও খুতবার) দিকে (বিনা বিলম্বে) রওয়ানা হয়ে যাও এবং বেচাকেনা (এবং অনুরূপ অন্যান্য কাজকর্ম যা নামাযের পানে ত্বরা করতে বিরত রাখে তা) বন্ধ কর । এটা তোমাদের জন্যে খুবই উত্তম যদি তোমরা বুঝ।’’ (আয়াত : ৯) 

জুমুআর আযান শ্রবণের পর পার্থিব যাবতীয় কাজকর্ম বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু আয়াতে করীমার শুধু বেচা-কেনা পরিত্যাগ করা নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জুমুআ প্রত্যেক স্থানে হয় না; বরং সে স্থানে হয় সে স্থানে লোকেরা সাধারণতঃ ব্যবসা বাণিজ্য এবং বেচা-কেনায় ব্যস্ত থাকে এবং যে স্থানে দৈনন্দিন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় ছোট বড় সবই ক্রয় বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে। শহর এবং গ্রামের মধ্যকার পার্থক্য এটাই যে, শহরসমূহে ব্যবসা-বার্ণিজ্য হয় এবং গ্রামসমূহে নয়। সুতরাং জুমুআ সে স্থানে হবে যে স্থানে ব্যবসা কেন্দ্র রয়েছে এবং তা শহরেই হয় গ্রামে নয়। 

❖ সুন্নতে নবী (সা.)
রসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র সুন্নত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, নবুওয়াতের যুগে জুমুআ কেবল শহরসমূতেই কায়িম হতো, গ্রামে হতো না । যেমন, 

১। জুমুআ মক্কা মুকাররামায় হিজরতরে পূর্বে ফরয হয়েছিল, আর রসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশক্রমে মদীনা তায়্যিবায়ও আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা মুকাররমায় জুমুআ আদায় করতে পারেননি।

যেমন আল্লামা শাওকানী (রহ.) নায়লুল আওতার’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩১ পৃষ্ঠায়, হাফিয ইবনে কায়্যিম (রহ.) যাদুল মাআদ’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৯৯ পৃষ্ঠায় এবং হাফিয সুয়ূতী (রহ.) আল ইতকান ১ম খণ্ডের ৩৬ পৃষ্ঠায় (النوع الثانى عشر) অনুচ্ছেদে ইহার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

 মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে রসূলুল্লাহ (সা.) (১২ই রবিউল আওয়াল) সোমবার কুবায় পৌঁছলেন এবং তথায় দশ দিনের অধিক অবস্থান করলেন,
 ( فلبث بضع عشرة ليلة ـ صحيح بخارى ص : ৫৫৫ ج : 1)
সহীহ বুখারী শরীফের অপর রিওয়ায়তে চৌদ্দ দিন অবস্থান করার কথা উল্লেখ রয়েছে (১ম খণ্ড ৫৬১ পৃ.) আর এক নুসখায় চব্বিশ দিন অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে (সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড ৬১ পৃ.) 
যদি চৌদ্দ দিন অবস্থান করেছেন বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও অন্ততঃ দু’টি জুমুআ পড়ার সুযোগ অবশ্যই হয়েছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) সেখানে জুমুআ কায়িম করেননি আর না কুবাবাসীদেরকে জুমুআ পড়তে হুকুম দিয়েছেন; বরং মদীনা তায়্যিবায় পৌঁছে জুমুআ আরম্ভ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ছোট পল্লীতে জুমুআ হয় না। এ কারণেই নবুওয়াতের দু’বছর কাল কুবায় জুমুআ হয়নি।

২। রসূলুল্লাহ (সা.) এর হজ্জে আকবর সর্বসম্মত মতে জুমুআর দিন হয়েছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) আরাফাতের ময়দানে জুমুআ পড়েননি আর না মক্কাবাসীগণকে সেখানে জুমুআ পড়তে হুকুম করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক স্থানে জুমুআ সহীহ হয় না; বরং এর জন্য বিশেষ প্রকারের জনবসতি হওয়া শর্ত।

৩। সহীহ বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের ১২৩ পৃষ্ঠায় হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে : 
كان الناس ينتابون الجمعة من منازلهم والعوالى*
অর্থাৎ মানুষ নিজ নিজ বাসস্থানে থেকে এবং দরিদ্র পল্লী থেকে জুমুআ পড়ার উদ্দেশ্যে পালাক্রমে আসতো।’

কুবাবাসীগণ জুমুআর জন্য পালাক্রমে মদীনা তায়্যিবায় আগমন থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 
এক এই যে, আহলে কুবার উপর জুমুআর নামায ফরয ছিল না। নতুবা তারা পালাক্রমে আসতো না; বরং সকলেই সমবেত ভাবে আসতো। যেমন হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) ফতহুল বারী’ গ্রন্থে উক্ত হাদীছের অধীনে লিখেন। 
‘‘আল্লামা কুরতুবী (রহ.) বলেন, আলোচ্য হাদীছে কুফীদের অভিমত খণ্ডন করা হয়েছে যে, তারা শহরের বাইরের লোকদের উপর জুমুআ ফরয বলে মনে করে না। কিন্তু আল্লামা কুরতূবীর এই মন্তব্য যথার্য নয়; (বরং বিবেচনার অবকাশ রয়েছে)। কেননা যদি জুমুআ শহরের বাইরের দরিদ্র পল্লীবাসীদের উপর ফরয হতো, তাহলে তারা পালাক্রমে আসতো না, বরং সবাই একযোগে আসতো।’’ (ফতহুল বারী ২য় খ- ৩০৯ পৃ.)।

দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়টি প্রতীয়মান হল যে, দরিদ্র পল্লীতে জুমুআ হয় না। নতুবা অন্যান্য ব্যক্তিরা তথায় জুমুআ পড়তেন।

৪। সহীহ বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, মসজিদে নবীর পর সর্ব প্রথম খুতবা বাহরায়ন অঞ্চলে অবস্থিত ‘জুওয়াছা’ নামক স্থানে আব্দুল কায়সের মসজিদে হয়েছিল।
আব্দুল কায়স প্রতিনিধি দলের আগমন হিজরী ৬ কিংবা ৮ সনে হয়েছিল। সে সময় ইমলাম মদীনা তায়্যিাবা থেকে দূরদূরান্ত পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) কোথাও জুমুআ কায়িম করার হুকুম দেননি। আর ‘জুওয়াছা’ প্রচীনকাল থেকে ব্যবসায়ী কেন্দ্র এবং দূর্গ ছিল। যেমন জাহেলীযুগের কবিতা এবং জ্ঞানীদের লেখনী থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ কারণেই আবূ দাউদ শরীফের রিওয়ায়তের মধ্যে একে গ্রাম বলা তেমনই যেমন কুরআন মজীদে মক্কা মুকাররামাকে قرية গ্রাম বলা হয়েছে। 

৫। নাসায়ী শরীফের ১ম খণ্ডের ২৩৫ পৃষ্ঠায়, আবূ দাউদ ১ম খণ্ডের ১৫৩ পৃষ্ঠায়, দারামী ১ম খণ্ডের ৩১৬ পৃষ্ঠায়, যায়েদ বিন আরকম (রা.) থেকে, আবূ দাউদ ১ম খণ্ডের ১৫৩ পৃষ্ঠায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে, ইবনে মাজাহ ৯৪ পৃষ্ঠায় এবং মাজমাউয যাওয়ায়িদ ২য় খণ্ডের ৫৬ পৃষ্ঠায় হযরত যাকওয়ান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। সবগুলো রিওয়ায়তের মুশতারিক বিষয়বস্তু এই যে, এক সময় জুমুআর দিনে ঈদ হয়েছিল। রসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামায আদায় করার পর ইরশাদ করলেন যে, 
‘আমরা তো জুমআর নামায আদায় করব, যাদের ইচ্ছে আমাদের সঙ্গে জুমুআ পড়তে পার আর ইচ্ছা করলে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতে পার।’’

এ ইরশাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে (শহরের পাশ্ববর্তী) দরিদ্র পল্লীবাসীদের স্বাধীনতা তথা অনুমতি দেয়া। কেননা তাদের উপর জুমুআ ফরয ছিল না। যেমন ইমাম তহাবী (রহ.) মুশকিলুল আছার গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৫২ পৃষ্ঠায় বলেন এবং মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ৩০৪ পৃষ্ঠায় ইবনে জুরায়জ (রা.) মুরসাল রিওয়ায়ত হিসাবে এর ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে।

فاذن للانصار فى الرجوع الى العوالى وترك الجمعة فلم يزل الامر على ذالك بعد*

অর্থাৎ ‘অতঃপর তিনি (সা.) আনসারগণকে স্বীয় পল্লীতে প্রত্যাবর্তন করার এবং জুমুআ না পড়ার অনুমতি দিলেন এবং এরপর সর্বদা ইহার উপরই আমল ছিল।’’

উপরোক্ত সমুদয় হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নবুওয়্যাতের যুগে জুমুআ কেবল শহরসমূহে কায়িম হতো। গ্রামে কখনো জুমুআ অনুষ্ঠিত হতো না।
❖ সালাফি সালিহীনের আমল
১। সহীহ বুখারী শরীফের ২য় খণ্ডের ৮৩৫ পৃষ্ঠায়, মুয়াত্তা ইমাম মালেক ৬৩ পৃষ্ঠায় হযরত উছমান (রা.) থেকে নকল করেন যে, তিনি ঈদায়নের খুতবায় বলেন, 
‘অদ্য তোমাদের দু’টো ঈদ একত্রিত হয়েছে। পল্লী এলাকায় লোকদের থেকে যে ব্যক্তি জুমুআ পড়তে ইচ্ছুক সে জুমুআর জন্য অপেক্ষা করুক আর যারা প্রত্যাবর্তন করতে চায় তাদের যাওয়ার অনুমতি আছে।’’ 
ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) মুয়াত্তা গ্রন্থের ১২৯ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘হযরত উছমান (রা.) পল্লীবাসিদেরকে এ জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন যে তারা শহরের বাসিন্দা নয়।’’ আর হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলুভী (রহ.) মাসাফফা শরহে ফারসী মুয়াত্তা’ গ্রন্থে উক্ত হাদীছ দ্বারা এ অনুচ্ছেদ কায়িম করেছেন। ‘‘পল্লী অঞ্চলে জুমুআ জায়েয নয় এবং পল্লীবাসীদের যারা শহরে রয়েছে  তাদের জন্য জুমুআর ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে প্রত্যাবর্তন করার অনুমতি আছে।’’ 

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : হযতর উছমান (রা.) এর বক্তব্যের উৎস রসূলুল্লাহ (সা.) এর সদাসর্বদার আমল। তিনি (সা.) পল্লীবাসীদেরকে কখনো জুমুআ কায়িম করতে বাধ্য করেননি। ’’ (১ম খণ্ড ১৫৪-১৫৫ পৃ.)

২। মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ১৬৮ পৃষ্ঠায় এবং মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২য় খণ্ডের ১০১ পৃষ্ঠায় সহীহ সনদে হযরত আলী (রা.) এর বাণী নকল করেন : 

لا جمعة ولاتشريق ولاصلوة فطر و لا اضحى الا فى مصر جامع او مدينة 
عظيمة*
অর্থাৎ জুমুআ, তাশরীক, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা শহর কিংবা কসবা তথা বড় গ্রাম ব্যতীত হয় না।’’

✪ ৩। মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩য় খণ্ডের ১৬৮ পৃষ্ঠায় হযরত আলী (রা.) থেকে ইহাও নকল করেছেন যে, তিনি বসরা, কুফা, মদীনা, বাহরায়ন, শাম, আল-জাযীরার ন্যায় শহরকে শহর গণ্য করতেন।

৪। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২য় খণ্ডের ১০১ পৃষ্ঠায় হযরত খুযায়ফা (রা.) এর বাণী নকল করেন : 
ليس على اهل القرى جمعة انما الجمع على اهل الامصار مثل المدائن*
অর্থাৎ পল্লীবাসীর উপর জুমুআ ফরয নয়। নিশ্চয় শহরবাসীরদের উপর জুমুআ ফরয, যেমন মাদায়েন শহর।’’

৫। সহীহ বুখারী ১ম খণ্ডের ১২৩ পৃষ্ঠায় আছে যে, হযরত আনাস (রা.) বসরা থেকে ছয় মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন, তিনি কোন দিন জুমুআর উদ্দেশ্যে বসরায় তাশরীফ আনতেন আর কোন সময় তাশরীফ আনতেন না।

৬। সহীহ বুখারী ১ম খণ্ডের ১২৩ পৃষ্ঠায় হযরত আতা (রহ.) এর অভিমত নকল করেছেন যে, জুমুআ বড়গ্রামে হয় আর মুসান্নাফে আবদির রাযযাক ৩য় খণ্ডের ১৬৮ পৃষ্ঠায় আছে যে, বড়গ্রাম (قرية جامعة) হচ্ছে, যেখানে আমীর হবে, এবং কাযী হবে। যেমন, জিদ্দা এবং তায়িফ।

এতদ্ব্যতীত আকাবির সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবেঈন (রহ.) এর বিভিন্ন বাণী মুসান্নিফে ইবনে আবী শায়বা ২য় খণ্ডের ১০১ পৃষ্ঠায় এবং মুসান্নাফে আবদির রাযযাক ৩য় খণ্ডের ১৬৮ পৃষ্ঠা থেকে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। 

উপরোল্লিখিত বিস্তারিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, জুমুআর ফরযিয়্যাত থেকে যেমন আরো অনেক লোক ব্যতিক্রম রয়েছে তদ্রুপ পল্লীবাসীরা এর নির্দেশিত নয়। 
হযরত আসআদ বিন যুরারাহ (রা.) এবং তার বন্ধুগণ যেখানে জুমুআ পড়েছিলেন তা পল্লী ছিলনা; বরং মদীনা তায়্যিবার সংলগ্ন স্থান ছিল। যা শহরের হুকুম ছিল। আর শহরে জুমুআ জায়েয।

মুসলমানের সংখ্যা যতই হোক না কেন কিন্তু জুমুআ শহরে হয়েছিল। আর সে যুগে মদীনা তায়্যিবায় বাজার থাকার বিষয়টি তো সহীহ বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের ৫৬১ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই মদীনা তায়্যিবাকে পল্লী বলা সহীহ বুখারীর পরিপন্থী হবে। 
والله اعلم بالصواب

❐ বি. দ্র. :  সন্মানিত পাঠকগণ আপনারা এই ব্লগ এর প্রতি দৃষ্টি রাখুন, কেননা এ বিষয়ে আরো অনেকগুলো দলীল বা প্রমাণ অচিরেই সংযোজিত হবে। 

✔ মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেকটি বিষয় দলীলসহ আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন


✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন