বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

খুতবা চলাকালীন সময়ে তাহইয়াতুল মসজিদ, কথা বলা ইত্যাদি নিষেধের দলীল ২য় পর্ব

খুতবা চলাকালীন সময়ে তাহইয়াতুল মসজিদ, কথা বলা ইত্যাদি নিষেধের দলীল
 ২য় পর্ব 
░▒▓█►হযরত সুলায়ক  গাতফানী (রা.) এর ঘটনা◄█▓▒
প্রশ্নের মধ্যে হযরত সূলায়ক গাতফানী (রা.) এর যে ঘটনার বরাত দেয়া হয়েছে সে সম্বন্ধে কতিপয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী।

১। পূর্বে এ বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে যে, কুরআন মাজীদ খুতবা শ্রবণ করা ও নিশ্চুপ থাকাকে ফরয সাব্যস্ত করেছে। আর রসূলুল্লাহ (সা.) এর মুতাওয়াতির হাদীছসমূহেও উক্ত বিষয়টিরই তাকীদ বর্ণিত হয়েছে। খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.), অর্ধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম (রা.) ও তাবেঈন (রহ.) কুরআন ও সুন্নতের উক্ত অকাট্য প্রমাণসমূহ সম্মুখে রেখে খুতবা পাঠকালে সালাত এবং কালাম তথা কথাবার্তা সমর্থক ছিলেন না। আর এটাই স্পষ্ট যে, সুলায়ক গাতফানী (রা.) এর ঘটনা তাদের জানা ছিল। কেননা আমরা তো উক্ত ঘটনা রিওয়ায়তের মাধ্যমে অবগত হয়েছি কিন্তু উল্লিখিত আকাবিরে হযরাত উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কেননা ঘটনাটি জুমুআর নামাযের গণসমাবেশ স্থলে ঘটেছিল। আর রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত সুলায়ক (রা.) কে উদ্দেশ্য করে যা কিছু ইরশাদ করেছেন, তা মিম্বরের উপর থেকেই করেছিলন। কাজেই উক্ত ঘটনার এ ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই যে, হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রা.) উক্ত ঘটনা এবং রসূলুল্লাহ (সা.) এর সে সম্পর্কিত ইরশাদের ইলম ছিল না।


আর এটাও হতে পারে না যে, হাযরাতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) জেনে-শুনে এবং কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে হাদীছে নবী (সা.) কে পরিত্যাগ করেছেন এবং হাদীছে নবীর অকাট্য দলীলের বিপরীত অভিমত পোষন করে থাকবেন। কেননা যদি এ সম্ভবনাকে স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে হযরাতে খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.), জমহুর সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবেঈন (রহ.) এর দ্বীন ও সততার উপর থেকেই বিশ্বাস্ততা উঠে যাবে। আর এ সম্ভাবনা তো কেবল রাফেযীদের মস্তিষ্কে আসতে পারে, কিন্তু কোন সহীহ আকীদা পোষনকারী কোন মুসলমান এর কল্পনাও করতে পারে না।

আর ইহাও প্রকাশ্য যে, উক্ত সকল আকাবিরে উম্মত আমাদের চেয়ে অধিকতর সুন্নতের অনুসারী এবং নেককর্মসমূহের প্রত্যাশী ছিলেন। রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত সুলায়ক (রা.) কে যে হুকুম দিয়েছেন, যদি তা সবার জন ব্যাপক হুকুম হতো, তাহলে সকল সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বিশেষভাবে হযরাতে খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) উক্ত হুকুম মুতাবিক আমল না করা অবম্ভব ছিল। আর উক্ত ছাওয়াবের কর্ম থেকে না কেবল নিজেরা বঞ্চিত থাকতেন; বরং অন্যান্যদেরকেও বঞ্চিত থাকতে নিষেধ করতেন।

২। উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যার যথার্থতা সম্পূর্ণ স্পষ্ট ও প্রকাশ্য, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত আকাবিরে হযরাত যখন সুলায়ক (রা.) এর হাদীছের উপর আমল করেননি, তখন এর কোন যুক্তিসংগত ও সহীহ কারণ অবশ্যই রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, সে কারণটি কি? 
এর জবাব কেবল আমাদের দায়িত্বই নয়; বরং সেই সকল লোকদের দায়িত্বেও রয়েছে, যারা হযরাতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) কে হক্ক এবং বিশ্বস্ততার পতাকাধারী তথা মাপকাঠি বলে বিশ্বাস করেন এবং যাদের মস্তিষ্ক রাফেযীদের মালিন্য থেকে মুক্ত রয়েছে। যদি কোন হাদীছের বিরোধীতার অভিযোগ ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এর প্রতি হয়, তাহলে এর জবাব দেয়ার দায়িত্ব হয়তো কেবল হানাফী মতাবলম্বীগণের উপর ফরয হয়ে দাড়ায়, কিন্তু খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) তো কেবল হানাফীগণের নয়। কাজেই যদি কোন হাদীছের বিরোধীতার অভিযোগ খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর প্রতি হয়, তাহলে এর জবাব দেয়ার দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয হয়ে যায়।

আর এখান থেকেই এই মূলতত্ত্বও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় যে, খবরে ওয়াহিদের গুরুত্ব কি অত্যধিক কিংবা খুলাফায়ে রাশিদীন এবং হযরাতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর আ’মলের গুরুত্ব অত্যধিক? অর্থাৎ যদি খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এবং অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর আ’মল কোন খবরে ওয়াহিদের বিপরীত হয় ( যেমন আমাদের আলোচ্য মাসয়ালায়) তাহলে খবরে ওয়াহিদকে ওয়াজিবুল আ’মল গণ্য করে কি উক্ত আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কে অভিযুক্ত করা যাবে? কিংবা উক্ত আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর আ’মলের আলোকে স্বয়ং খবরে ওয়াহিদকে তাবীল তথা ব্যাখ্যাযোগ্য বলে অনুভব করা হবে? প্রথম রাস্তাটি রাফেযী ও বিদআতীদের দিকে যায় এবং দ্বিতীয় রাস্তাটি ما انا عليه واصحابى (আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর রয়েছেন আল-হাদীছ) এর দিকে রয়েছে। সুতরাং এখন প্রত্যেক ব্যক্তির এই স্বাধীনতা রয়েছে যে, উক্ত রাস্তাদ্বয়ের যে কোন একটি রাস্তা গ্রহণ করে নেবে।

৩। উক্ত আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) হযরত সুলায়ক গাতফানী (রা.) রিওয়ায়তকে যে আমলযোগ্য মনে করেননি, আমাদের মতে এ দুটি কারণ হতে পারে। 
❑ এক, এই যে, তারা জানতেন যে, সুলায়ক (রা.) কে রসূলুল্লাহ (সা.) দু’ রাকআত পড়ার যে হুকুম দিয়েছিলেন, তা ব্যাপক হুকুম নয়; বরং ইহা কেবল তারই জন্য একটি বিশেষ ও ব্যতিক্রমধর্মী হুকুম ছিল। 
❑ দুই, এই যে, উক্ত আকাবিরে হযরাতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) অবহিত ছিলেন যে, এ ঘটনার পর রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা পাঠকালে সালাত ও কালাম করতে নিষেধ করেছেন। কাজেই এখন উক্ত হুকুম রহিত হয়ে গেছে।

৪। রসূলুল্লাহ (সা.) এর ইরশাদটি যে শুধু হযরত সুলায়ক (রা.) এর জন্য বিশেষত্ব ছিল এবং তা ব্যাপক হুকুম ছিল না, এর কিছু কারণ নিন্মে উদ্ধৃতি করা হলো। 

(ক) বিশেষত্বের এক দলীল এই যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যে, তারা খুতবা চলাকালীন সময়ে উপস্থিত হয়েছেন অথচ রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের দু’ রাকআত আদায় করতে হুকুম দেননি। উদাহরণত : 

১। সহীহ বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের ১২৭ পৃষ্ঠায়  باب الاستسقاء فى المسجد এর মধ্যে সেই ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যিনি খুতবা চলাকালীন সময়ে এসেই বৃষ্টির জন্য দু’আর দরখাস্ত করে ছিলেন। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দু’ রাকআত পড়তে হুকুম দেননি।

২। অতঃপর উক্ত রিওয়ায়তে সেই ব্যক্তির পরবর্তী জুমুআর আসার কথা উল্লেখ রয়েছে। কন্তিু সে সময়ও তাকে দু’ রাকআত পড়ার নির্দেশ দেননি।

৩। আবূ দাঊদ ১ম খণ্ডের ১৫৬ পৃষ্ঠায় باب الامام يكلم الرجل فى خطبته এর মধ্যে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা পাঠকালে এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন ‘বসে যাও’। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) তখনও মসজিদের দরজার বাইরে ছিলেন, পবিত্র ইরশাদ শুনে তিনি সে স্থানেই বসে গেলেন। অতঃপর যখন রসূলুল্লাহ (সা.) এর মুবারক দৃষ্টি তার উপর পতিত হলো তখন তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন, ইবনে মাসউদ! ভিতরে এসে যাও; কিন্তু তিকি তাকে দু’ রাকআত পড়ার হুকুম দেননি। 

৪। আবূ দাউদ ১ম খণ্ডের ১৫৯ পৃষ্ঠায় এবং নাসায়ী ১ম খণ্ডের ২০৭ পৃষ্ঠায় সেই ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যিনি খুতবা চলাকালীন সময়ে লোকদের গ্রীবাসমূহের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছিল। রসূললুল্লাহ (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন اجلس فقد اذيت ‘বসে যাও, তুমি লোকদেরকে কষ্ট দিচ্ছ।’’ কিন্তু তাকে দু’ রাকআত পড়ার হুকুম দেননি।

(খ) রিওয়ায়তসমূহ এ বিষয়ে সম্মত যে, রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত সুলায়ক (রা.) কে বসে যাওয়ার পর তাকে দু’ রাকআত পড়ার হুকুম দিয়েছিলেন। অথচ বসে যাওয়ার পর তাহইয়াতুল মসজিদ অকেজো হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি মসজিদে উপবিষ্ট রয়েছে তার জন্য খুতবা পাঠকালে নফলসমূহ পড়া কারো মতে জায়েয নয়। কাজেই যতি ইহা বিশেষ ও ব্যত্রিকমধর্মী হুকুম না হতো, তাহলে তার বসে যাওয়ার পর (আর তাও খুতবা চলাকালীন সময়ে) তাকে নফল পড়া হুকুম দেয়া হতো না।

(গ) অধিকন্তু রিওয়ায়তসমূহ থেকে ইহাও প্রতীয়মান হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) তখনো মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলেন, (দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়া শুরু করেননি) হযরত সুলায়ক (রা.) এসে বসে গেলেন। এ থেকে মনে হচ্ছে যেন তার সঙ্গে কথাবার্তা খুতবা চলাকালীন সময়ে হয়নি; বরং খুতবা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে হয়েছিল। যেমন সহীহ মুসলিম শরীফের ১ম খণ্ডের ২৮৭ পৃষ্ঠায় আছে : 

جاء سليك الغطفانى يوم الجمعة ورسول الله صلى الله قاعد على المنبر فقعد سليك قبل ان يصلى الخ*

অর্থাৎ ‘হযরত সুলায়ক গাতফানী (রা.) জুমুআর দিন সে সময় উপস্থিত হলেন যখন রসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলেন। সুতরাং হযরত সুলায়ক (রা.) নামায পড়ার পূর্বেই বসে পড়েলেন। 

ইমাম নাসায়ী (রহ.) সুনানে কুবরা’ গ্রন্থে উপরোক্ত রিওয়ায়তের ভিত্তিতে এ অনুচ্ছেদ কায়িম করেছেন باب الصلوة قبل الخطبة (অনুচ্ছেদঃ খুতবার পূর্বে নামাযের বর্ণনা।)-(নসবুর রায়াহ ২য় খ- ২০৪ পৃ.)।

অধিকন্তু ইহাও বর্ণিত আছে যে, হযরত সুলায়ক (রা.) যতক্ষণ পর্যন্ত না দু’ রাকআত নামায পড়া শেষ করেছেন ততক্ষণ রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা শুরু করেননি। যেমন দারা কুতনী ১৬৯ পৃষ্ঠায় রিওয়ায়তে আছে : 
فقال النبى صلى الله عليه وسلم قم فاركع ركعتين ، وامسك عن خطبته حتى فرغ من صلوته*

অর্থাৎ ‘নবী করীম (সা.) ইরশাদ করলেন, উঠ! দু’ রাকআত পড়ে নাও। আর রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা দেয়া থেকে বিরত রইলেন। যতক্ষণনা হযরত সুলায়ক (রা.) স্বীয় নামায থেকে অবসর হলেন।’’

ইমমা দারা কুতনী উক্ত রিওয়ায়তকে মুসনাদ এবং মুরসাল উভয়ভাবে রিওয়ায়ত করে লিখেন যে, মুরসাল সহীহ। আর মুরসাল রিওয়ায়ত যদি সহীহ হয়, তাহলে অনেক আহলে ইলমের মতে দলীল হিসাবে গৃহীত হয়। আর যদি তা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় কিংবা এর সমর্থনে অন্য কোন রিওয়ায়ত বিদ্যমান থাকে, তাহলে সকল আহলে ইলমের মতে দলীল হিসাবে গৃহীত হয়। এখানে শেষোক্ত তরীকাই বিদ্যমান রয়েছে। কেননা ইমাম দারা কুতনী (রহ.) আরো একটি রিওয়ায়ত (আবূ মা’শার থেকে, তিনি মুহাম্মদ থেকে, তিনি কায়স (রহ.) এর সূত্রে) উক্ত রিওয়ায়তের সমর্থনে নকল করেন। এই রিওয়ায়ত মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা গ্রন্থে এই শব্দসমূহে রয়েছে : 
ان النبى صلى الله عليه وسلم حيث امره ان يصلى ركعتين امسك عن الخطبة حتى فرغ من ركعته ثم عاد الى خطبته* (ابن ابى شيبة ص : ২১০ دار قطنى ص : ১৬৯)

অর্থাৎ ‘নবী করীম (সা.) যখন হযরত সুলায়ক (রা.) কে দু’ রাকআত পড়ার হুকুম দিয়েছিলেন তখন খুতবা থেকে বিরত রইলেন। এমন কি যখন তিনি দু’ রাকআত পড়ে শেষ করলেন তখন তিনি পুনরায় খুতবা আরম্ভ করলেন। ’’

উক্ত রিওয়ায়াতের রাবীকে ইমাম দারা কুতনী যঈফ বলেছেন। কিন্তু এ রিওয়ায়ত উপরোল্লিখিত মুরসালে সহীহকে অতিরিক্ত শক্তির যোগান দিয়েছে। অধিকন্তু হাদীছে ইহাও  প্রত্যক্ষ করা যায় যে, হযরত সুলায়ক (রা.) অতীব অভাবাক্রান্ত ও অনুগ্রহযোগ্য অবস্থায় এসেছিলেন সেহেতু রসূলুল্লাহ (সা.) তাকে সাহায্য করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কে উৎসাহিত করলেন। ফলে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম (রা.) নিজের পরিধেয় জামা কাপড় খুলে পেশ করলেন। আর রসূলুল্লাহ (সা.) তন্মধ্যে দু’টি কাপড় তাকে প্রদান করলেন। (নাসায়ী ১ম খ- ২০৮ পৃ.)

সম্ভবতঃ এসব কর্ম থেকে অবসর হয়ে রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা আরম্ভ করেছিলেন। যার আলোচনা দারাকুতনী এবং ইবনে আবী শায়বা এর রিওয়ায়তে পূর্বে এসেছে।

সুতরাং এসব বিষয়গুলো যা উক্ত ঘটনায় ঘটেছে অর্থাৎ হযরত সুলায়ক (রা.) দু’ রাকআত নামায আদায় পর্যন্ত রসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা থেকে বিরত থাকা, সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কে চাঁদার জন্য উৎসহিত করা এবং সাহবায়ে কিরাম (রা.) পরিধেয় কাপড় দান করা প্রভৃতি কর্মগুলো খুতবার সাধারণ নিয়মের পরিপন্থী হয়। কাজেই এগুলো তারই বিশেষত্বের উপর প্রয়োজ করা যেতে পারে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও যদি কারো জেদ হয় যে, তা হযতর সুলায়ক (রা.) এর সঙ্গে বিশেষত্ব নয়; বরং খুতবা চলাকালীন সময়ে তাহইয়াতুল মসজিদ পড়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ব্যাপকভাবে সুন্নত তাহলে আমাদের বলতে হয় যে, যদি খুতবা চলাকালীন সময়ে দু’ রাকআত পড়া হযরত সুলায়ক (রা.)এর সুন্নত হয়, তাহলে এ প্রকার ব্যক্তির জন্য খতীব সাহেব স্বীয় খুতবা থেকে বিরত থাকা রসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নত হবে কাজেই খতীবের জন্য অপরিহার্য যে, তাহইয়াতুল মসজিদ আদায়কারীদের প্রতি লক্ষ্য করে খুতবা থেকে বিরত হয়ে সুন্নতে নবী (সা.) এর উপর আমল করা। এমন  তো হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় যে, মুকতাদীগণ তো হযরত সুলায়ক (রা.) এর সুন্নতের উপর আমল করছে আর খতীব সাহেবের উপর নবী (সা.) এর সুন্নতের পাবন্দী অপরিহার্য হবে না। হ্যাঁ! হযরত সুলায়ক (রা.) এর সুন্নতের উপরও তখনই পুরোপুরি আ’মল হবে যখন প্রথমে মসজিদে এসে বসে যাওয়া হবে। অতঃপর খতীব সাহেব তাকে দু’ রাকআত আদায় করার নির্দেশ দেবেন। অতঃপর তার দু’ রাকআত নামায আদায় সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বীয় খুতবা পাঠ বন্ধ রাখবেন। অতঃপর উপস্থিত লোকদের থেকে তার জন্য চাঁদাও আদায় করে দেবেন। তার পর পুনরায় খুতবা দেয়া শুরু করবেন। 

এ তাহকীক (তথা নিশ্চয়তা প্রতিপাদন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত সুলায়ক (রা.) ও দু’ রাকআত হুবহু খুতবা পাঠকালে আদায় করেন  নি। কেননা রসূলুল্লাহ (সা.) তার জন্য খুতবা বন্ধ করে রাখলেন, তখন তো তা আর খুতবা চলাকালীন সময় থাকলো না। এতদ্ব্যতীত রসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে অন্য কাউকে কিয়াস করা যায় না। কেননা রসূলুল্লাহ (সা.) এর আহবানে হুবহু নামাযের হালাতেও লব্বায়িক বলা ওয়াজিব। কাজেই রসূলুল্লাহ (সা.) হয়তো কোন উপযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে যখন হযরত সুলায়ক (রা.) কে দু’ রাকআত পড়ার হুকুম দেন তখন হুবহু খুবা অবস্থায়ও ইরশাদে নবী (সা.) এর উপর আ’মল করা অপরিহার্য ছিল এবং সে সময় তার থেকে খুতবা শ্রবণের ফরয মুলতবি ছিল। কিন্তু অন্যদের জন্য ইহা জায়েয নয় যে, খুতবা শ্রবণের ফরয পরিত্যাগ করে নফল (তথা তাহইয়াতুল মসজিদ) আদায়ে ব্যস্ত হওয়া।

(ঘ) বিশেষত্বের একটি দলীল ইহাও যে, সহীহ ইবনে হেব্বান এর রিওয়ায়ত অনুযায়ী রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত সুলায়ক (রা.) কে বলেছিলেন : 

اركع ركعتين ولاتعودن لمثل هذا* (موارد الظمان ص : ১৫০ نصب الراية : ص : ২০৩ ج : ১) 

অর্থাৎ ‘তুমি দু’ রাকআত পড়। আর ভবিষ্যতে কখনো এরূপ করো না।’’

আর দারা কুতনীর এক রিওয়ায়তে আছে 
ولاتعد لمثل هذا*

অর্থাৎ ‘আর ভবিষ্যতে এর অনুরূপ করো না।’’

যারা খুতবা চলাকালীন সময়ে তাহইয়াতুল মসজিদ পড়া জায়েয বলে থাকেন, তারা উপরোক্ত ইরশাদের এই ব্যাখ্যা করেন যে, এতে তাকে বিলম্বে আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। কেননা তিনি পরবর্তী জুমুআয়ও দু’ রাকআত না পড়ে বসে গিয়েছিলেন তখন রসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দু’ রাকআত পড়তে হুকুম দিয়েছিলন।

কিন্তু হযরাতে খুলাফায়ে রাশিদীন এবং অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম (রা.) উক্ত ইরশাদের মর্ম এই বুঝেছেন যে, ভবিষ্যতে দু’ রাকআত পড়তে নিষেধ করেছেন, যার একটি ইঙ্গিত তো ইহাই যে, এই নিষেধাজ্ঞাটি দু’ রাকআতের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই এরই নিষেধাজ্ঞা হবে। 
দ্বিতীয় ইঙ্গিত এই যে, হযরত সুলায়ক (রা.) পরবর্তী জুমুআয়ও দু’ রাকআত পড়েননি, তা উক্ত ইরশাদেরই উপর আমল ছিল। নতুবা ইহা অসম্ভব যে, তিনি গত জুমুআর নসীহত ভুলে যাবেন। আর রসূলুল্লাহ (সা.) পরবর্তী জুমুআয়ও তার দ্বারা দু’ রাকআত পড়ানোরও কোন বিশেষ উপযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে হবে। কেননা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) অন্য কোন সাহাবা দ্বারা পড়াননি।

সারকথা হচ্ছে যে, খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) জমহুরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবেঈন (রহ.) হযরত সুলায়ক (রা.) এর রিওয়ায়তকে শরীআতের ব্যাপক হুকুম হিসাবে গ্রহণ করেন নি। এর একটি কারণ এই যে, রিওয়ায়তসমূহে বিভিন্ন ইঙ্গিত রয়েছে যে, বিষয়টি তার বিশেষত্ব।

৫। আর উক্ত রিওয়ায়তকে ব্যাপক আমল রূপে গ্রহণ না করার দ্বিতীয় কারণ এই হতে পারে যে, খুতবা চলাকালীন সময়ে নামায ও কথাবার্তার নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীতে নাযিল হয়েছিল। আমাদের সামনে তো কুরআন মজীদ এবং হাদীছে নবী (সা.) এর ভাণ্ডার একই সময়ে পুরোপুরি ভাবে হস্তগত হয়েছে। কাজেই আমাদেরকে তো ইহা জানার জন্য যে, কোন আয়াত প্রথম নাযিল হয়েছে এবং কোন আয়াত পরে, কোন ইরশাদখানা রসূলুল্লাহ (সা.) প্রথমে বলেছেন এবং কোনটি পরে? নকল এবং রিওয়ায়তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু হযরাতে খুলাফায়ে রাশিদীন এবং আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর জন্য কুরআন মজীদের আয়াতসমূহের অবতরণের এবং রসূলুল্লাহ (সা.) এর ইরশাদসমূহের তরতীব (তথা আগে পরের বিন্যাস) পর্যবেক্ষিত বস্তু ছিল। তারা জানতেন যে, কোন আয়াত কখন এবং কোন স্থলে নাযিল হয়েছে। আর রসূলুল্লাহ (সা.) এর কোন ইরশাদ কোন স্থল ও কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন? কোন হুকুম প্রথমে ছিল এবং কোনটি পরে? আল ইতকান গ্রন্থে النوع الثمانون এর মধ্যে হযরত আলী (রা.) থেকে নকল করেন যে, তিনি খুতবায় বলেছেন : 

سلونى، فوالله لا تسألون عن شئ الا اخبركم، وسلونى عن كتاب الله ، فوالله مامن من اية الا وانا اعلم بليل نزلت ام بنهار ام فى سهل ام فى جبل* 

অর্থাৎ ‘আমাকে জিজ্ঞাসা কর। আল্লাহ তায়ালার কসম! তোমরা আমার নিকট যে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা কর আমি তার উত্তর দেব। আর আমার কাছে কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। আল্লাহ তাআলার কসম! কুরআন মজীদের এমন কোন আয়াত নেই যার সম্পর্কে আমি ভালভাবে অবগত নই যে, তা কি রাতে অবতীর্ণ হয়েছে কিংবা দিনে? ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে কিংবা পাহাড়ে?

আর হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) এর বাণী নকল করেছেন যে,
والله الذى لا اله غيره ما نزلت من اية من كتاب الله الا وانا اعلم فيمن نزلت واين نزلت* (ايضا)

অর্থাৎ ‘সেই মাহিমাম্বিত আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই। কুরআন মজীদের এমন কোন আয়াত নেই, যার সম্পর্কে আমি উত্তম ভাবে অবহিত নই যে, তা কি সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে এবং কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে?

সুতরাং এই সকল আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) যখন এ রিওয়ায়তের মুকাবালায় উক্ত নসূস তথা আয়াত ও হাদীছসমূহের উপর আমল করেন, যাতে খুতবা চলাকালীন সময় নামায ও কথাবার্তার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে, তখন এ রিওয়ায়ত যদি বিশষত্বের উপর প্রয়োগ না হয় তাহলে অবশ্যই তা متروك العمل (আমল বর্জিত) হবে।

৬। যে সকল হযরাত সুলায়ক (রা.) এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণ পেশ করে খুতবা চলাকালীন সময়ে তাহইয়াতুল মসজিদ পড়ার উপর জোর দিয়ে থাকেন তাদেরকে এই বিষয়ে গভীর চিন্তা করা উচিত যে, তাহইয়াতুল মসজিদ সাধারণ অবস্থায়ও মুস্তাহাব আর খুতবা শ্রবণ করা ফরয। মুস্তাহাবের উপর আমল করার জন্য কি ফরয পরিত্যাগ করা জায়েয আছে? আর তাহইয়াতুল মসজিদ না পড়া অবস্থায় যদিও একটি হাদীছের উপর আমল করা থেকে বঞ্ছিত হওয়া অপরিহার্য হয় বটে, কিন্তু খুতবা শ্রবণ করা এবং নীরব থাকা যে ফরয তা পরিত্যাগ করার কারণে তো কুরআন মজীদ, মুতাওয়াতির হাদীছসমূহ এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর বিপরীত করা অপরিহার্য হয়। একটি হাদীছের উপর আমল করার জন্য কি কুরআন মজীদ, মুতাওয়াতির হাদীছসমূহ এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর হুকুম থেকে ফিরে থাকা জায়েয আছে?

░▒▓█►হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) এর ঘটনা◄█▓▒
প্রশ্নের মধ্যে তিরমিযী শরীফের বরাতে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) এর ঘটনাকে রঙ মিশিয়ে উল্লেখ করে খুতবা চলাকালীন সময়ে নামায পড়ার নিষেধাজ্ঞাকে ‘মারওয়ানী বিদআত’ বলা হয়েছে। এ বিষয়টি পূর্বোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়েছে যে, ইহা মারওয়ানী হুকুম নয়; বরং কুরআনী হুকুম। আর তা মারওয়ানী বিদআত নয়; বরং রসূলুল্লাহ (সা.) এবং হযরাতে খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর সুন্নত। যে বিষয়টি কুরআনে করীম, সুন্নতে মুতাওয়াতিরা এবং খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) এর আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, উহাকে কেবল মারওয়ান সমর্থন করেছেন বলেই মারওয়ানী বিদআত’ বলে দেয়া কিভাবে সহীহ হবে? সম্ভবতঃ তারা জুমুআর সম্পূর্ণ খুতবাকেই মারওয়ানী বিদআত’ বলে দিচ্ছেন।

রইল এই বিষয়টি যে, হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) দু’ রাকআত পড়তে জোর দেয়ার বিষয়টির উপর দলীল হিসাবে তো তারা সেই হযরত সুলায়ক (রা.) এর ঘটনাই পেশ করেছেন। আর তা থেকে দু’ রাকআত নামায পড়া জায়েয হওয়ার মাসয়ালা উদ্ভাবন করেছেন। অথচ খুলাফায়ে রাশিদীন এবং আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর বিপরীত ফাতওয়া দিয়েছে। কাজেই এখন বিবেক ইনসাফ করে বলুন যে, আমাদের কোন তরীকা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

আর এ অধমের ধারণায় তো হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) এ স্থলে জোর দেয়ার বিষয়টি অন্য কোন কথারই ইঙ্গিত বহন করছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই যে, যালিম আমীরদের যুগে সালাফে সালিহীনের মধ্যে মাসয়ালাটি আলোচনাধীন ছিল যে, যদি ইমাম খুতবার মধ্যে যিকর পরিত্যাগ করে অপ্রাসঙ্গিক কথা আরম্ভ করে, তাহলে কি তা শ্রবণ করা অপরিহার্য হবে? 
কতক আকাবিরের অভিমত ছিল যে, ইমাম যেহেতু যিকর থেকে বের হয়ে গেছেন আর যিকরের শ্রবণই কেবল অপরিহার্য হয়, তার অপ্রাসঙ্গিক কথা নয়, সেহেতু সেই সময় তার খুতবার বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। ফলে খুতবা শ্রবণ ওয়াজিব থাকে না। 
যেমন মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ২২৬ পৃষ্ঠায় আছে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসূফ খুতবা দিচ্ছিলেন আর ইমাম শাবী (রহ.) এবং আবূ বুরদা (রহ.) পরস্পর কথা বলছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, আপনি খুতবা চলাকালীন সময়ে কথাবার্তা বলছেন? তিনি জবাবে বললেন, এসব অপ্রাসঙ্গি কথা শ্রবণের জন্য নীরবতা অবলম্বনের হুকুম দেয়া হয়নি।

 আর মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১২৬ পৃষ্ঠায় হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী (রহ.) এবং সাঈদ বিন যুবায়র (রা.) এর থেকে অনুরূপ ঘটনা নকল করা হয়েছে। এ তো অসম্ভব নয় যে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.)ও এইরূপ অবস্থায় সম্মুখীন হয়ে ছিলেন। তাই তিনি নামায আরম্ভ করে ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি হযরত সুলায়কা (রা.) এর হাদীছের বরাত দেয়াও যথাস্থানে সঠিক হবে। কেননা হযরত সুলায়কা (রা.) এর দু’ রাকআত নামায আদায়ের সময় খুতবা বন্ধ রাখা হয়েছিল। অনুরূপ আমিও খুতবা বন্ধ থাকার অবস্থায় দু’ রাকআত আদায় করেছি।
والله اعلم بالصواب

❐ বি. দ্র. :  সন্মানিত পাঠকগণ আপনারা এই ব্লগ এর প্রতি দৃষ্টি রাখুন, কেননা এ বিষয়ে আরো অনেকগুলো দলীল বা প্রমাণ অচিরেই সংযোজিত হবে। 

✔ মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেকটি বিষয় দলীলসহ আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন


✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন