মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৫

সমস্ত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সুলাইমান (আ.) এর যিয়াফত

সমস্ত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সুলাইমান (আ.) এর যিয়াফত
(জাল বা ভিত্তিহীন কাহিনীর কবলে ঈমানের মেহনত)

❖ প্রশ্ন : আমাদের দেশে বিভিন্ন বক্তা ও সাধারণ মানুষ, আল্লাহ তায়ালা কত বড় রিযিক দাতা সে কথাটি বুঝাতে গিয়ে (ঈমান বৃদ্ধির লক্ষে) নিন্ম ঘটনাটি উল্লেখ করে থাকে। আমার জানার বিষয় হলো উক্ত ঘটনাটি কতটুকু সঠিক?

 হযরত সুলাইমান (আ.) একবার আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ আমি সকল সৃষ্টিজীবকে এক বছর খাওয়াতে চাই। আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান তুমি তা পারবে না। তখন সুলাইমান (আ.) বললেন, আল্লাহ! তাহলে এক সপ্তাহ। আল্লাহ বললেন, তুমি তাও পারবে না। সুলাইমান (আ.) বললেন, তাহলে একদিন। আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান তুমি তাও পারবে না। একপর্যায়ে আল্লাহ এক দিনের অনুমতি দিলেন। সুলাইমান আলাইহিস সালাম জিন ও মানুষকে হুকুম করলেন, পৃথিবীতে যত প্রকার খাদ্য শস্য আছে এবং হালাল যত প্রকার প্রাণী আছে সব হাযির কর। তারা তা করল। এরপর বিশাল বিশাল ডেগ তৈরী করা হল এবং রান্না করা হল। তারপর বাতাসকে আদেশ করা হল, সে যেন খাদ্যের উপর দিয়ে সদা প্রবাহিত হতে থাকে যাতে খাবার নষ্ট না হয়। তারপর খাবারগুলো সুবিস্তৃত যমিনে রাখা হল। যে যমিনে খাবার রাখা হল তার দৈর্ঘ্য ছিল দুই মাসের পথ। খাবার প্রস্তুত শেষ হলে আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান! কোন প্রাণী দিয়ে শুরু করবে? সুলাইমান আ. বললেন, সমুদ্রের প্রাণী দিয়ে। তখন আল্লাহ সাগরের একটি বড় মাছকে বললেন, যাও সুলাইমানের যিয়াফত খেয়ে এস। তখন মাছটি সমুদ্র থেকে মাথা উঠিয়ে বললো, হে (আল্লাহর নবী) সুলাইমান, আপনি নাকি যিয়াফতের ব্যবস্থা করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এইতো খাবার প্রস্তুত তুমি শুরু কর। তখন সে খাওয়া শুরু করল এবং খেতে খেতে খাবারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পৌছে গেল। সব খাবার শেষ করে ফেলল। তারপর বলল, আমাকে আরো খাবার দিন, আমি এখনও তৃপ্ত হইনি। তখন সুলাইমান (আ.) বললেন, তুমি সব খাবার খেয়ে ফেলেছ তাও তোমার পেট ভরেনি। তখন মাছ বলল, মেজবান কি মেহমানের সাথে এভাবে কথা বলে? হে (আল্লাহর নবী) সুলাইমান! শুনে রাখুন, আমার রব আমাকে প্রতিদিন এর তিন গুণ খাবার দেন। আজ আপনার কারণে আমাকে কম খেতে হল। এ কথা শুনে সুলাইমান (আ.) সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন...। 


 আরবীতে ঘটনাটি নিন্ম রূপে পাওয়া যায়-
✿ سيدنا سليمان عليه السلام لما رأى أن الله تعالي أوسع له الدنيا وصارت بيده قال: الهي لو أذنت لي ان أطعم جميع المخلوقات سنة كاملة . فأوحي الله إلية أنك لن تقدر فقال أسبوعاً فقال الله تعالي لن تقدر فقال الهي يوماً واحداً فقال الله تعالي لن تقدر  . فقال إلهي مقصودي ولو يوماً واحداً، فأذن الله تعالى له في ذلك ، فأمر سليمان الجن والإنس بأن يأتوا بجميع مافي الأرض من أبقار وأغنام ومن جميع ما يؤكل من أجناس الحيوانات من طير وغير ذلك . فلما جمعوا ذلك اصطنعوا له القدور الراسيات ثم ذبح ذلك وطبخه وأمر الريح أن تهب على الطعام لئلا يفسد ثم مد ذلك الطعام في البرية فكان طول ذلك السماط مسيرة شهرين وعرضه مثل ذلك ثم أوحي الله إليه : ياسليمان بمن تبتدئ من المخلوقات ؟ فقال سليمان : ابتدئ بدواب البحر . فأمر الله حوتاً من البحر المحيط أن يأكل من ضيافة سليمان فرفع ذلك الحوت رأسه وقال: يا سليمان سمعت أنك فتحت باباً للضيافة وقد جعلت عليك ضيافتي في هذا اليوم :فقال سيدنا سليمان : دونك والطعام فتقدم ذلك الحوت وأكل من السماط فلم يزل يأكل حتى أتى على أخره في لحظة ثم نادي أطعمني ياسليمان وأشبعني فقال سليمان :أكلت الجميع وماشبعت ؟ فقال الحوت :اهكذا يكون جواب أصحابة الضيافة للضيف ؟ اعلم يا سليمان أن لي في كل يوم مثل ماصنعت ثلاث مرات وأنت السبب في منع راتبي في هذا اليوم وقد قصرت في حقي . عند ذلك خر سليمان ساجداً لله تعالي وقال:سبحان المتكفل بأرزاق الخلائق من حيث لايعلمون. 

❖ জবাব : এ ঘটনাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। হাদীস, তাফসীর বা ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণ কিছু কিতাবে পাওয়া যায় যেমন ( خطبات ذوالفقار للعلامة ذو الفقار احمد نقشبندى) খুতুবাতে যুলফিকার বাংলা 1ম খণ্ডের 205 নং পৃষ্ঠায় ও (بدائع الزهور في وقائع الدهورمن تأليف العالم الفاضل الشيخ محمد ابن احمد ابن اياس الحنفي رحمة الله عليه) বায়ায়েউয যুহুর ফি ওকায়েউদ দুহুর ইত্যাদি কিতাবাদির মাঝে উক্ত ঘটনাটি উল্লেখ রয়েছে। 

❀ তাছাড়া এ ঘটনার মাঝে এমন কিছু বিষয় আছে যা নিজেই প্রমাণ করে যে, ঘটনাটি সত্য নয় (সম্পূর্ণ বানানো ও ভিত্তিহীন) ।    
1. মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন-
{وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا} [هود: 6]
অর্থাৎ : আর পৃথিবীতে এমন কোন বিচরণশীল প্রাণী নেই, যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর তায়ালা গ্রহণ করেন নি। (সূরা হুদ আয়াত : 06)।
ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে সমগ্র মানুষের রিযিক এর দায়িত্ব গ্রহণ করা এটি এক মাত্র মহান আল্লাহর দ্বারাই সম্ভব, কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তাহলে হযরত সুলাইমান (আ.) একজন নবী হওয়ার সত্ত্বেও কেন আল্লাহর সাথে নির্ধারিত গুনাগুন এর মাঝে অংশিদার হতে চেয়েছেন? যার দ্বারা একথাটি প্রমাণিত হয় যে, উক্ত ঘটনাটি ভিত্তিহীন। কেননা কোন নবী আল্লাহর ‍সাথে নির্ধারিত গুনাগুন এর মাঝে কখনো অংশিদার হওয়ার আবদার করবেন না।
2. একজন নবী এমন উদ্ভট ও অযৌক্তিক আবদার করবেন তা হতে পারে না। এর অর্থ দাড়ায় আল্লাহর মাখলুক সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। একজন নবীর শানে এ রকম ধারণা করা সমীচীন নয়। 
3. আল্লাহ নিষেধ করার পরও একজন নবী এরকম আবদার করতে থাকবেন। আর আল্লাহও তাকে এমন অযৌক্তিক বিষয়ের অনুমতি দিয়ে দিবেন তা কীভাবে হয়?  
4. পৃথিবীর সকল প্রাণীই কি রান্না করা খাবার খায়? মাছ কি রান্না করা খাবার খায়? 
5. ঘটনায় বলা হয়েছে, খাবার যে যমীনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার দৈর্ঘ্য দুই মাসের পথ। মাছটি কি দুই মাসের পথ মুহূর্তেই অতিক্রম করে ফেলল? বা এত দীর্ঘ পথ জলের প্রাণী স্থলে থাকল কীভাবে?   
6. যে মাছের পেটে এত খাবার সংকুলান হয় সে মাছটি কত বড়! 
7.শুধু বাতাস প্রবাহিত হওয়াই কি পাক করা খাদ্য নষ্ট না হওয়ার জন্য যথেষ্ট? এ ধরনের আরো অযৌক্তিক কথা এ কিচ্ছায় রয়েছে। যা এ ঘটনা মিথ্যা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমন ঘটনা  বর্ণনা করা যেমন বৈধ নয় তেমনি বিশ্বাস করাও মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।

✔ মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেকটি বিষয় তাহকীকসহ বলার করার তাওফীক দান করুন। আমীন


✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন