মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৫

বিতরের দু’ রাকআতের পর বসা ও দু’আয়ে কুনূতে হাত বাঁধার দলীল

 বিতরের দু’ রাকআতের পর বসা ও দু’আয়ে কুনূতে হাত বাঁধার দলীল
✪ বিতরের দু’ রাকআতের পর তাশাহুদ পড়ার জন্য বসা জরুরী এবং এর কয়েকটি কারণ রয়েছে : 
প্রথম :  শরীআত প্রত্যেক নামাযে দু’ রাকআতের পর বসা অত্যাবশ্যক গণ্য করেছে। যেমন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে : 

وكان يقول فى كل ركعتين التحية* (صحيح مسلم ص : ১৯৪ ج : ১)

❏ অর্থাৎ‘ রসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করতেন যে, প্রত্যেক দু’ রাকআতের পর ‘আত্তাহিয়্যাতু’ রয়েছে।’’


    আর তিরমিযী শরীফের ১ম খণ্ডের ৫০ পৃষ্ঠায় হযরত ফযল বিন আব্বাস (রা.) থেকে রিওয়ায়ত আছে : 

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الصلوة مثنى مثنى تشهد فى كل ركعتن* الحديث

    অর্থাৎ ‘রসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, নাাময দু’ দু’ রাকআত হয়ে থাকে, প্রত্যেক দু’ রাকআতে তাশাহুদ রয়েছে।’’

এই বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আরো বিভিন্ন হাদীছ রয়েছে। সংক্ষিপ্ততার প্রতি লক্ষ্য করে তা উল্লেখ করছি না। এই করণেই ইমাম আহমদ (রহ.) নামাযে প্রত্যেক দু’ রাকআতের পর বসাকে ফরয বলে থাকেন। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এর মতে ওয়াজিব। আর ইমাম মালিক (রহ.) ও ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর মতে সুন্নত। মাযহাবসমূহের এই বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক দু’ রাকআতের পরে বসা ওয়াজিব হওয়ার অভিমতই হলো সম-পরিমিত অভিমত।

মোটকথা, যখন শরীআত নামাযের জন্য একটি উসূল ও নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এর প্রতি দু’ রাকআতের পর বসতে হবে, চাই সে নামায ফরয হোক কিংবা নফল, সুন্নত হোক কিংবা ওয়াজিব, তখন বিতর নামাযকেও এর কানূনেরই অধীনে রাখা হবে।

দ্বিতীয় :  হযরত ইবনে উমর (রা.) এর হাদীছ : 

صلوة الليل مثنى مثنى*

অর্থাৎ ‘রাতের নামায দু’ দু’ রাকআত হয়ে থাকে।

      বিশেষভাবে রাতের নামায এবং বিতর সম্বন্ধেই উক্ত ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে। যেমন পূর্বে আলোচিত হয়েছে। নবী (সা.) এর ইরশাদ রাতের নামায দু’ দু’ রাকআত হয়।’’ এর মধ্যে দু’টি মাসয়ালার বিষয়ে উপদেশ দেয়া হয়েছে। 
❁ এক নামাযের নূন্যতম নিসাব দু’ রাকআত । এ থেকে কম নামায হয় না। এটাই কারণ যে, ফরয ও নফলসমূহের মধ্যে আমরা এমন কোন নামায পাইনি, যার মধ্যে শরীআত এক রাকআত পড়াকে জায়েয রেখেছে এবং একে নামায হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রকাশ্য যে, বিতরের নামাযও উক্ত কানূনের অধীনে এসে গিয়েছে এবং শুধু এক রাকআত বিতরকে নামায বলা হবে না। 
❁ দ্বিতীয় মাসয়ালা এই যে, প্রতি দু’ রাকআতের পর আত্তাহিয়্যাতু পড়ার উর্দ্দেশ্যে বসা জরুরী। কেননা, বসা ব্যতীত দু’ রাকআতের অস্তিত্বই স্থিত হতে পারে না। যেমন মুসলিম শরীফের ১ম খণ্ডের ২৫৭ পৃষ্ঠায় উক্ত রিওয়ায়তে এতটুকু অতিরিক্ত রয়েছে-
قيل لابن عمر ما مثنى مثنى؟ قال ان تسلم فى كل ركعتين*

❏ অর্থাৎ‘ হযরত ইবনে উমর (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, দু’ দু’ রাকআতের মর্ম কি? তিনি জবাবে বললেন, তুমি প্রতি দু’ রাকআতের পর সালাম বলবে।’

এখানে সালাম বলার দ্বারা মর্ম আত্তাহিয়্যাতু পড়া। যেমন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) এর হাদীছে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা.) এর ইরশাদ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতি দু’ রাকআতের পর আত্তাহিয়্যাতু রয়েছে।’’

অধিকন্তু তাবরানী (রহ.) এর জামে কবীর’ গ্রন্থে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে রিওয়ায়ত আছে : 

ان النبى صلى الله عليه وسلم قال فى كل ركعتين تشهد وتسليم على المرسلين وعلى من تبعهم من عباد الله الصالحين* (وفيه على بن يزيد واختلف فى الاحتجاج به وقد وثق ـ مجمع الزوائد ص : ১৩৯ ج : ২)

অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন যে, প্রতি দু’ রাকআতের পর তাশাহহুদ রয়েছে এবং রসূলগণ ও তাদের অনুসরণকারী আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাগণের প্রতি সালাম রয়েছে।’’

মোটকথা, বিভিন্ন হাদীছে এই উসূল বর্ণনা করা হয়েছে যে, নামাযের প্রতি দু’ রাকআতের পর তাশাহহুদ পড়তে হবে। আর হযরত ইবন উমর (রা.) থেকে রাতের নামায এবং বিতর সম্বন্ধে বর্ণিত হাদীছের মধ্যেও এই মূলনীতিকেই চিহ্নতি করা হয়েছে। কাজেই বিতর নামাযের মধ্যে দু’ রাকআতের পর তাশাহুদকে ওয়াজিব না বলার কোন কারণ নেই।

তৃতীয় : হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রা.) থেকে যে সব রিওয়ায়তে ইহা বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) পাঁচ, সাত কিংবা নয় রাকআত বিতর পড়তেন। এর ব্যাখ্যা এই যে, উহাতে রাতের নামায এবং বিতর নামাযকে সমষ্টিগতভাবে বিতর বলা হয়েছে। নতুবা মুতাওয়াতির হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর বিতর তিন রাকআত হতো। যেমন সা’দ বিন হিশাম (রহ.) এর রিওয়ায়তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি উহার দু’ রাকআতের পরে তাশাহহুদও পড়তেন। কিন্তু সালাম ফেরাতেন না। হুবহু এটাই হানাফীগণের মাযহাব।

চতুর্থ : শরীআতের মধ্যে এমন কোন নামায নেই, যা কেবল এক রাকআত পড়া জায়েয কিংবা কাতিপয় দু’ রাকআত নামায তাশাহহুদ ব্যতীত একত্রিত করে পড়া জায়েয রেখেছে। যে সব ব্যক্তিবর্গ বিতর নামাযে শরীআতের এই কানূনকে ভেঙ্গে দেন এবং রাবীগণের প্রকাশভঙ্গী থেকে ভুল বুঝে জড়িত হয়ে এই ফাতওয়া দেন যে, বিতর নামায পাঁচ, সাত কিংবা নয় রাকআত এক সালামেই এবং এক বৈঠকেই পড়া জায়েয সে সব লোকদের জন্য কি ইহা সহীহ হবে যে, তারা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর হাদীছ-


 صليت مع النبى صلى الله عليه وسلم ثمانية جميعا وسيعا جميعا 

❏ অর্থাৎ : আমি রসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে যুহর ও আসরের) আট রাকআত এবং (মাগরিব ও ইশার) সাত রাকআত একসঙ্গে পড়েছি।) 
এর প্রতি লক্ষ্য করে এ ফাতওয়াও দিয়ে দেবে যে, যুহর ও আসরের আট রাকআত এবং মাগরিব ও ইশার সাত রাকআত এক বৈঠকে এবং এক সালামেই জায়েয। আর সে সব বুযুর্গ الوتر ركعة من اليل (বিতর হলো রাতের এক রাকআত) হাদীছ খানাকে দেখে এই ফাতওয়া দিয়ে থাকেন যে, বিতর নামায এক রাকআতও জায়েয আছে, তাদের জন্য কি ইহা সহীহ হবে যে, তারা  الحج عرفة (আরাফাই হজ্জ) হাদীছখানার ভিত্তিতে এই এই ফাতওয়া দিয়ে থাকবেন যে, শুধু ‘ওকূফে আরাফা’ দ্বারা হজ্জ হয়ে যায়, এর জন্য অপর কোন আরকান ও মানাসিকে হজ্জ আদায় করা জরুরী নয়? কিন্তু উক্ত সকল প্রকাশভঙ্গী দ্বারা যখন কেউ ভুল বুঝে জড়িত হয় না, কেননা যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও ইশার নামাযসূহের রীতি-নীতি সকলের জ্ঞাত বিষয়, অনুরূপ হজ্জের আরকান এবং মানাসিকও প্রকাশিত রয়েছে; তখন অনুরূপভাবে আমরা বলছি যে, মুতাওয়াতির হাদীছসমূহ দ্বারা বিতর নামাযের রীতি-নীতি জ্ঞাত বিষয় যে, তা তিন রাকআত। কাজেই রাবীগণের অবশিষ্ট প্রকাশভঙ্গীগুলোকে উক্ত মূলনীতির অধীনে প্রয়োগ করা হবে। আর এরূপ করা যাবে না যে, এক একজন রাবীর প্রকাশভঙ্গীকে এক একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ মূলনীতি বানিয়ে এর বাস্তবায়নের জন্য মুতাওয়াতির দ্বারা প্রমাণিত মূলনীতিকে ভেঙ্গে দেয়া যাবে।

░▒▓█►দু’আয়ে কুনূতে হাত বাঁধার দলীল◄█▓▒

বিতরের কুনূতে যুক্তির ভিত্তিতে তিনটি আকৃতি বের করা সম্ভব। 
❶ এক- কুনূত পড়ার সময় হস্তদ্বয় উত্তোলন রাখা যেমন দু’আর সময় উত্তোলন করা হয়। 
❷ দুই- হাতদ্বয় ছেড়ে রাখা যেমন রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় হাত ছেড়ে রাখা হয়। 
❸ তিন- হাতদ্বয় উত্তোলন করার পর উভয় হাত বেঁধে রাখা যেমন নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় রাখা হয়। 
        প্রথম তরীকা হানাফীগণের মতে পছন্দনীয় নয়; কেননা শরীআত নামাযের মধ্যে যতগুলো দু’আ নির্ধারণ করেছে সেগুলোর কোথাও হাত উঠিয়ে দু’আ করার নির্দেশ দেয় নি। অথচ হাতদ্বয় উঠানো দু’আর আদবসমূহের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু নামাযের মধ্যে হাত উঠিয়ে দু’আ করার হুকুম নেই। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) একে বিদআত বলেন : 

عن ابن عمر رضى الله عنهما قال ارأيتم قيامكم عند فراغ الامام من السورة، هذا القنوت ، والله انه بدعة ، ما فعله رسول الله صلى الله عليه وسلم غير شهر ثم تركه ـ ارأيتم رفعكم فى الصلوة والله انه لبدعة ، مازاد رسول الله صلى الله عليه وسلم على هذا قط ـ فرفع يديه حيال منكبيه* ( رواه الطبرانى فى الكبير وفيه شهر بن حوشب ، ضعفه احمد و ابن معين وابو زرعة وابو حاتم والنسائى و وثقه ايوب وابن عدى ، مجمع الزوائد ص : ১৩৭ ، ج : ২)

  অর্থাৎ ‘হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, দেখো! তোমরা যে (ফজরের নামাযে) ইমাম কিরাআত তিলাওয়াত সমাপ্ত করার পর কুনূত পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে যাও; আল্লাহর কসম! ইহা বিদআত। রসূলুল্লাহ (সা.) তো এক মাসের অধিক ইহা করেন নি; বরং পরে তা ছেড়ে দিয়েছেন। দেখো! নামাযের মধ্যে যে তোমরা হাতদ্বয় উঠিয়ে দু’আয়ে কুনূত পড়, আল্লাহ তা’আলার কসম! ইহা বিদআত। রসূলুল্লাহ (সা.) তো কেবল কাঁধ পর্যন্ত হস্তদ্বয় উত্তোলন করতেন।’’

বহ্যিক ভাবে এর মর্মার্থ ইহাই যে, কুনূতের জন্য হস্তদ্বয় উত্তোলন করা তো রসূলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত আছে বটে, কিন্তু নামাযের অব্যন্তরে সেইরূপ হাতদ্বয় উঠিয়ে দু’আ করা যেইরূপ নামাযের বাইরে দু’আর জন্য হাতদ্বয় উঠানো হয় থাকে, এর কোন প্রমাণ নেই। 

এখন রইল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আকৃতি। কুনূত যদি রুকুর পূর্বে পড়া হয় যেমন বিতর নামাযে পড়া হয়ে থাকে; তাহলে রুকুর পূর্বের অবস্থা যেহেতু কিয়াম তথা দণ্ডায়মানের অবস্থা, আর নামাযে দণ্ডায়মান অবস্থায় হাত বেঁধে রাখা সুন্নত সেহেতু বিতর নামযে তা গ্রহণ করা হবে। 

আর কুনূতে নাযিলাহ যেহেতু রুকুর পরে কাওমা তথা দাঁড়ানো অবস্থায় পড়া হয় আর কাওমা অবস্থায় হাত বাঁধা সুন্নত নয়; বরং ছেড়ে রাখা সুন্নত সেহেতু কুনূতে নাযিলাহ হাত ছেড়ে রেখে পড়া হবে। এ কারণেই হানাফীগণের মতে বিতর নামাযের কুনূত নামাযের কিয়াম তথা দণ্ডায়মান অবস্থায়কৃত আমলের মুতাবিক হাত বেঁধে পড়া হয়ে থাকে।


❐ বি. দ্র. :  সন্মানিত পাঠকগণ আপনারা এই ব্লগ এর প্রতি দৃষ্টি রাখুন, কেননা এ বিষয়ে আরো অনেকগুলো দলীল বা প্রমাণ অচিরেই সংযোজিত হবে। 

✔ মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেকটি বিষয় দলীলসহ আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন


✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন